Thank you for trying Sticky AMP!!

কল্পনা চাকমা বলে কেউ ছিল না!

কল্পনা চাকমা। হারিয়ে গেছেন অনেক আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। ভুল লিখলাম। কল্পনা হারিয়ে যাননি। তিনি রাজনৈতিক ‘হারিয়ে’ যাওয়ার শিকার হয়েছিলেন। কল্পনার অপরাধ কী ছিল? তাঁর অপরাধ ছিল গুরুতর। তিনি গর্জে উঠেছিলেন পাহাড়ে জারি থাকা নিপীড়ন এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাঁর লড়াই ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধেও। কল্পনা ছিলেন অবিভক্ত হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। কল্পনার চিন্তা ছিল সম্ভবত পাহাড়ের চেয়েও উঁচু। সেই চিন্তায় তেজ ছিল, ক্ষিপ্রতা ছিল। আরও ছিল লড়িয়ে মেজাজ। সেই মেজাজে ভর দিয়ে কল্পনা এই পাহাড় থেকে সেই পাহাড় ডিঙিয়ে চলছিলেন। সেই তীব্রতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কল্পনাকে পাহাড় থেকে অপহরণের মাধ্যমে। সম্ভবত কল্পনার অপহরণই পাহাড়ের নিপীড়নের সংস্কৃতিকে অনেকভাবে চিনতে সহায়তা করেছে আমাদের। কল্পনার অপহরণ শান্তিচুক্তি-পরবর্তী পাহাড়ের রাজনীতিতে তির হয়ে আজও গেঁথে আছে।

২০ বছর বয়সী, পাহাড়ের বেশ কিছুটা ‘দুর্গম’ অঞ্চলে বড় হওয়া কল্পনা নিজেকে তৈরি করেছিলেন অনেক আগ থেকেই, যা কল্পনার ডায়েরি পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাঁর চিন্তায় ছিল প্রতিবাদ আর আদর্শের ধারালো বীজ। সেটি থেকে অনেক বড় কিছু পাহাড়ে চাষবাদ হবে, সেই ভয় থেকেই অপহরণ করা হয়েছিল কল্পনা চাকমাকে। সেই অপহরণের তদন্ত নিয়েও হয়েছিল রাষ্ট্রীয় নানা নাটক। কল্পনা অপহরণের মামলায় ৩৫ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছিলেন। দফায় দফায় তদন্ত কর্মকর্তা পাল্টালেও পাল্টায়নি তাঁদের তদন্তের মানসিকতা। তাঁর দুই ভাই টর্চের আলোতে স্পষ্টভাবে অপহরণকারীদের দেখেছেন, তার পরও কোনাভাবেই তদন্তকাজ এগোয়নি। যার কারণে পাহাড় থেকে অপহরণের এত বছর পরও ন্যায়বিচারের কোনো আলো দেখা দেয়নি।

অপহরণের ২০ বছর পর ২০১৬ সালে তদন্ত শেষের ঘোষণা দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ এবং সেই সঙ্গে মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লোজ করে দেওয়া হয়। সাধারণত কোনো মামলার তদন্তে কিছু না পেলে মামলাটি আর এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, সেটিকে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলে গ্রহণ করা হয়। কল্পনার অপহরণের অনেক বছর পরও বেঁচে ছিলেন কল্পনার মা। কল্পনাকে যখন বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়, তখন তাঁর মা এবং দুই ভাই বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু তার পরও বলা হয়েছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলেই পুরো মামলাই মরে গেছে।

২৩ বছর পার হলো। অপহরণের এক বছর পর করা বহুল আলোচিত শান্তিচুক্তিতেও কল্পনার অপহরণ বা পাহাড়ে নারী নিপীড়ন নিয়ে কোনো ধারা নেই। শান্তিচুক্তির পর কল্পনা বিষয়ে অনেকটাই চুপ থেকেছেন চুক্তি সম্পাদনকারী পাহাড়ি নেতারাও। শুধু কল্পনাই নন, পাহাড়ের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে যেসব নারী যুক্ত ছিলেন, পুরো শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ায় তাঁদেরও দূরে রাখা হয়েছে। এখন শুধু কল্পনার অপহরণ দিবসে দু-চারটা কথা বলা হয়। কল্পনা বুঝতে পেরেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের শক্ত বোঝাপড়াকে।

কল্পনার এই অপহরণ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন একটা বড় সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঘেঁষা ছিল। আদিবাসী নারীদের বিষয়াবলি একেবারেই গুরুত্বহীন থেকেছে মূল ধারার নারী আন্দোলনে। যতটুকু মনে পড়ে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চর্চিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঘরানার নারী আন্দোলনে কল্পনার অপহরণ প্রথম পাহাড়ি এবং বাঙালি নারী আন্দোলনের মধ্যে সেতু স্থাপন করে। তখন থেকে নারী আন্দোলনে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসী নারীদের বিষয়গুলো স্থান পেতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, কল্পনা স্থান পান প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভার্চ্যুয়াল প্রতীক হিসেবে। এখন নারী আন্দোলনের এই অন্যতম স্লোগান, ‘আমাদের ধমনিতে কল্পনা চাকমার রক্ত, এই রক্ত কোনো দিন পরাভব মানে না...’।

কেমন আছে কল্পনার পাহাড়? যে পাহাড়কে নিপীড়নমুক্ত করার জন্য কল্পনা নিজেকে সর্বোত্তমভাবে তৈরি করেছিলেন। কল্পনার সেই পাহাড়ে আজও থামেনি নিপীড়নের সংস্কৃতি। তুচ্ছ ঘটনায় জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। চলছে ধড়পাকড় আর অপহরণ। বাজছে নানা দিক থেকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। পাহাড় ভেঙেছে। শুধু ভাঙেইনি, রাজনৈতিক দলগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত হচ্ছে। চর্চিত হচ্ছে নিপীড়নের নতুন নতুন কৌশল। এখন শত্রু-মিত্র চেনা বড়ই কঠিন। প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে এর পরিচয়। এর মধ্য দিয়েই ফসকে গেছে কল্পনার অপহরণটি।

কল্পনা আমার বন্ধু। যিনি আমাকে বলেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস। যাঁর মুখে আমি শুনেছি লোগাং এবং নানিয়ারচর গণহত্যার ঘটনাগুলো। যিনি আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভিন্নভাবে পাঠের চোখ। আমার কাছে কল্পনা তাঁর ২০ বছর বয়স নিয়েই থমকে আছেন। ২০-এর কল্পনা এই বয়সেই ছিলেন আমাদের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা মানুষ। সেই কল্পনার বয়ানেই আমি প্রথম পাহাড় কল্পনা করি। তাঁর গ্রামকে অনুভব করি। কল্পনাই আমার সেই কৈশোর মাড়িয়ে একটু এগিয়ে থাকা সময়ে প্রথম পাহাড়ের রাজনীতি বুঝিয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন পাহাড়ের শিক্ষাগুরু। কল্পনা অপহৃত হওয়ার দিন দশেক আগে আমাদের দেখা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরেই। তিনি এসেছিলেন ইপিজেডে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। তাই কল্পনার অপহরণ ঘটনার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই আমি পাহাড় দেখি, পাহাড়ের পাল্টে যাওয়া রাজনীতি দেখি, আর এর ভেতরই দেখি আমারই ভালোবাসার বন্ধু কল্পনাকে।

কল্পনা চাকমা কেন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? কেন কল্পনার লড়িয়ে স্মৃতি আমাদের জিইয়ে রাখতে হবে? কারণ খুবই স্পষ্ট। কল্পনার লড়াই, সংগ্রাম ও অপহরণের ঘটনা যদি আমরা হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমরা আসলে দূরে সরে যাব পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়নের ইতিহাসে থেকে। তাই অপহরণ মামলা মরে গেলেও কল্পনাকে মনে রাখতে হবে...স্লোগানে, জীবনযাপনে।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: zobaidanasreen@gmail.com