কর্মসংস্থান

কে বলে দেশে চাকরি নেই

দেশে উন্নয়নের অগ্রধারা অব্যাহত রাখতে দক্ষ কর্মী সৃষ্টির বিকল্প নেই। ফাইল ছবি
দেশে উন্নয়নের অগ্রধারা অব্যাহত রাখতে দক্ষ কর্মী সৃষ্টির বিকল্প নেই। ফাইল ছবি

গত বছর ৫ অক্টোবর যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে দিনব্যাপী চাকরি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় দেশি-বিদেশি ৩০টি প্রতিষ্ঠান যোগ দিয়েছিল। ভালো কর্মী পেলে সঙ্গে সঙ্গে চাকরি, অন্তত ১০ হাজার সফটওয়্যার কর্মী চাকরি পাবেন—এ রকমই পরিকল্পনা ছিল।

আবেদনপত্র পড়ল অন্তত ৩৩ হাজার। কিন্তু বাছাই করে মাত্র ১৭ জন উপযুক্ত মানের কর্মী পাওয়া গেল। সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো যে ধরনের পেশাগত দক্ষতা চায়, সে রকম পাচ্ছে না। অথচ চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রায় সবাই গ্র্যাজুয়েট। মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। তাহলে তাঁদের কেন এমন দক্ষতার ঘাটতি? এক দিকে লাখ লাখ তরুণ চাকরির জন্য ঘুরছেন, অন্যদিকে শত শত কোম্পানি লাখ লাখ দক্ষ কর্মী খুঁজছে। চাকরিদাতা ও চাকরিপ্রার্থীদের চাওয়া-পাওয়া মিলছে না। মিলন ঘটানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে সেটা হতে পারে? এই সমস্যা নিয়ে সেদিন প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও। পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কীভাবে কতটা হতে পারে, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কয়েকজন ব্যক্তি আলোচনা করেন।

কেন তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না? কেন চাকরিদাতাদের বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনতে হচ্ছে? দক্ষ কর্মী যে আমরা তৈরি করতে পারি না, তা নয়। যশোর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল সৈয়দ আবদুল আজিজ বললেন, যশোরের কয়েকটি আইটি কোম্পানি তাঁদের কাছে দক্ষ কর্মী চেয়েছিল। তিনি যতজন কর্মী দিয়েছিলেন, তাঁদের সবাই চাকরি পেয়েছেন।

এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ তিনি শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই দেন না। বিভিন্ন কোম্পানি যে ধরনের দক্ষতা চায়, সেটাও তিনি শেখান। এটাই হলো মূল ব্যাপার। আজকের বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ে যা লেখা আছে, দু-চার বছরে হয়তো তা সেকেলে হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি বাজারে এসে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলো সেগুলো ব্যবহার করছে। তাই শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের কলাকৌশল শিখতে হবে।

কিন্তু নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হাতে–কলমে শেখার কাজটি কীভাবে করা যায়? এ জন্য দরকার সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। যশোর চাকরি মেলার আগে যদি সরকারি ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক করত, ওরা ছয় মাসের একটা প্রশিক্ষণ কোর্স করত, যে ধরনের দক্ষ কর্মী দরকার, সে বিষয়ে হাতে–কলমে শেখার ব্যবস্থা করত, এমনকি প্রশিক্ষণ পর্যায়ে কোম্পানিগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু ভাতার ব্যবস্থাও করতে পারত, তাহলে নিশ্চয়ই সেদিন সফটওয়্যার পার্কের মেলায় ১৭ জন নয়, ১৭ হাজার দক্ষ কর্মী বাছাই করা যেত।

চাকরি মেলার উদ্বোধনী ভাষণে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বলেছিলেন, আইটি সেক্টরে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিন বছরে ৩ লাখ তরুণ-তরুণীকে দক্ষ করে তোলা হবে। তাহলে তো ২০২১ সালের মধ্যে আইটি সেক্টরে ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তখন আর বলার সুযোগ থাকবে না যে দেশে চাকরি নেই। সরকারের এই উদ্যোগ সফল করতে হলে বেসরকারি উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে। একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। চাকরির ব্যাপারটা নির্ভর করছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সাফল্যের ওপর।

কাজটা সহজ নয়। যেমন, পঞ্চগড়ের জেম জুট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মোনায়েম বললেন, তিনি সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রশিক্ষণের সময় নাশতা ও কিছু হাতখরচের ব্যবস্থাও করেছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের মিলে চাকরির নিশ্চয়তাও দিলেন। প্রারম্ভিক বেতন হবে অন্তত ১০-১২ হাজার টাকা। ওরা এসএসসি পাস করে টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল ট্রেনিং শেষ করেছে। যাঁরা এইচএসসি পাস করে তিন বছরের ডিপ্লোমা করেছেন, তাঁদের আরও বেশি বেতনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তারপরও দেখা গেল ২০ শতাংশের বেশি টেকেনি।

কেন এ রকম হচ্ছে? এর কারণ অনেকটাই মানসিকতা। অনেকে মনে করেন, এত পড়াশোনা করে কেন শ্রমিকের চাকরি করবেন? অথচ এখন জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখে বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। এই শিল্পে এখন ৫০ লাখের বেশি দক্ষ কর্মী দরকার। চাকরি আছে। কিন্তু অনেক তরুণের মনে ধরে না। এটা আমাদের সামাজিক সমস্যা। মর্যাদা ও কাজের সুন্দর ও স্বচ্ছ পরিবেশ এই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে পারে।

দক্ষ কর্মী সৃষ্টিতে আইএলও সহায়তা দিচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ওরা টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট কোর্স চালু করেছে। কিন্তু আইএলও তো কাজটা শুধু ধরিয়ে দিতে পারে। সেই ধারা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব আমাদের। এবং এটা খুবই সম্ভব। আমাদের বিরাট সম্ভাবনা আছে। অথচ সেটা কাজে লাগাতে পারছি না। আলোচনায় প্রধান অতিথি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। তিনি একবার একটি টেকনিক্যাল কলেজে গিয়ে জানতে পারেন যে তাঁদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য যেসব মেশিন দেওয়া হয়েছে, ওগুলো তাঁরা চালাতে পারেন না। কারণ, বইতে যে বড় বড় মেশিনের বিষয়ে পড়ানো হয়, ওগুলোর মডেল ভিন্ন। তাই হাতে–কলমে কাজ শেখানো যাচ্ছে না।

এটা কি কোনো সমস্যা হলো? বইতে বড় মেশিনের কথা শেখানো হয়, আর ল্যাবে আছে তারই অনুকরণে একটি ছোট মডেলের মেশিন। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটুকু জেনে নিলেই তো চলে। অথবা ওই ধরনের মেশিন এলাকার যেসব কারখানায় আছে, সেখানে কয়েক দিন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের আয়োজন করা যেতে পারে। কারখানার মালিকও নিশ্চয়ই খুশি হবেন। কারণ, প্রশিক্ষণের পর ওরাই তো হবে তাঁর কারখানার দক্ষ কর্মী।

আলোচনায় অনেকেই বলেন, প্রতিটি টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজকে হতে হবে এলাকার সব কারখানার প্রযুক্তির হাব বা কেন্দ্রবিন্দু। এলাকার কোনো কারখানার মেশিনে সমস্যা হলে ওরা যাবে টেকনিক্যাল স্কুলে। সেখান থেকে শিখে আসবে ত্রুটি মেরামতের উপায়।

আলোচনায় আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিয়াইনেন যথার্থই বলেছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শুধু সরকার নয়, সেই সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় ঘটাতে হবে। তাদের এক লাইনে আসতে হবে। আমাদের দেশে উন্নয়নের অগ্রধারা অব্যাহত রাখতে হলে দক্ষ কর্মী সৃষ্টির বিকল্প নেই।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail.com