ঢাকা মহানগরী

গণপরিবহনে এই বিশৃঙ্খলা কেন?

রাজধানীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার যেন কেউ নেই। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
রাজধানীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার যেন কেউ নেই। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

ঢাকার রাস্তায় দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত মাসে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় মানুষের অঙ্গহানি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গণপরিবহনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। 

গণপরিবহনের ব্যবস্থাপনা বুঝতে হলে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ, তাঁদের প্রণোদনা এবং আচরণ অনুধাবন করা জরুরি। ঢাকার বাস রুট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে চারটি পক্ষ যুক্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জনসাধারণ, বাসের মালিক-শ্রমিক ও তাঁদের সংগঠন, বিআরটিএ ঢাকার আঞ্চলিক দপ্তর এবং পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন হাজার বাস ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে। এই নগরে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য বাস রয়েছে মাত্র ৩০টি। উচ্চ চাহিদা থাকায় এখানে বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু রুট পারমিট পেতে অপ্রাতিষ্ঠানিক চাঁদা, আবেদনকারীর রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সম্পর্ক, তদবির প্রভৃতি যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।

অন্যদিকে, অনুমতি পাওয়ার পর তা ধরে রাখতে বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয়। যেমন রাস্তায় একটি নতুন বাস নামলে বাস মালিক ও শ্রমিক সমিতি পায় দৈনিক ৭০ টাকা, দৈনিক ৩ হাজার বাস হিসাবে যা মাসে ৬৩ লাখ এবং বছরে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা।

বাস রুটের অনুমতি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ২০ সদস্যবিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। কমিটিতে সরকার এবং পরিবহন মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি থাকলেও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব নেই। অনুমতির আগে মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা হয় অনুমানের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস যুগপত্ভাবে চলাচল করে। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
ভাড়া আদায়ের বিদ্যমান পদ্ধতিও রাস্তায় বিশৃঙ্খলার জন্য বহুলাংশে দায়ী। বর্তমানে দুভাবে বাসের ভেতরে ভাড়া আদায় করা হয়।

প্রথমত বাস মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে পুরো দিনের জন্য চালকদের কাছে বাস ভাড়া দেন; বাড়তি আয় চালক ও সহকারী ভাগ করে নেন। দ্বিতীয়ত ওয়ে-বিল ব্যবস্থা, যাতে বাস কোম্পানির কর্মী বিলে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেন এবং দিন শেষে যাত্রীর সংখ্যার সঙ্গে মিল রেখে বাসচালক ও সহকারী বাসমালিককে টাকা বুঝিয়ে দেন এবং মালিক ট্রিপ হারে তাঁদের বেতন দেন।

উভয় ব্যবস্থায় চালকেরা যত্রতত্র, আড়াআড়িভাবে বাস থামিয়ে অন্য চালকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। যত বেশি যাত্রী তত বেশি আয়। বেপরোয়া চালনায় একদিকে বাসের বাহ্যিক অবয়ব নষ্ট হয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে যায়, অন্যদিকে যত্রতত্র গাড়ি থামানোয় ভ্রমণ-সময় দীর্ঘায়িত হয়।

এ দুই ব্যবস্থার বিপরীতে প্রায় এক দশক আগে বাসমালিকেরা রুট ধরে নির্দিষ্ট দূরত্বে টিকিট কাউন্টার স্থাপন করেছিলেন, যেখান থেকে যাত্রীদের টিকিট সংগ্রহ করে লাইন ধরে বাসে উঠতে তো। টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে কোম্পানির লোকেরা যাত্রাপথে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করতেন। তখন চালক ও সহকারীদের মনোযোগ থাকত কাউন্টার থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর দিকে।

ফলে যত্রতত্র বাস থামানো কমে গিয়ে যানজট পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। কিন্তু সরকার ফুটপাত দখলমুক্ত করার নামে এসব কাউন্টার উচ্ছেদ করায় বাসের ভেতরে ভাড়া আদায়ের আগের ব্যবস্থা ফিরে আসে।

ঢাকায় যাত্রী ওঠানামার স্থান সব সড়কে সুনির্দিষ্ট করা নেই বা থাকলেও তা কার্যকর নেই। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা নগরীর যানজটের ওপর প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ‘স্টেট অব সিটিজ ২০১৬’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যত্রতত্র বাস থামলে বা চালকেরা আইন ভাঙলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়।

ট্রাফিক আইন ভঙ্গে উভয় পক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অনানুষ্ঠানিক সমাধা করাকে শ্রেয়তর মনে করে, কারণ তা দ্রুত ও সাশ্রয়ী। আইন প্রয়োগকারীদের মতে, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির মান ও চালনায় অনিয়মের মামলা দিতে গেলে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে।

গণপরিবহনের ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হলে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য যা যা করা দরকার: রুট পারমিটের প্রক্রিয়া সংস্কার করা, দক্ষ ও পেশাদার চালক তৈরির পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা; টিকিট কাউন্টার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ও অনলাইন টিকিটের ব্যবস্থা প্রবর্তন; বিআরটিএকে শক্তিশালী করে গাড়ির মান যাচাই এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহির ব্যবস্থা করা; ভালো কোম্পানিকে এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা এবং ট্রাফিক আইন মানতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপের ফলে ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা আসবে এবং জনচলাচল নিরাপদ হবে।

মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম: নগরবিষয়ক গবেষক ও শিক্ষক, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
sirajul@bracu.ac.bd