
মহামারিকালে বিধিনিষেধের সময় পুরুষদের ঘরের কাজে অংশ নেওয়ার হার সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এটি ৪৭টি দেশের নারী ও পুরুষের মধ্যে জরিপের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, যা চতুর্থ স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফাদারস রিপোর্টে (জুন ২০২১) অন্তর্ভুক্ত। মেনকেয়ার: আ গ্লোবাল ফাদারহুড ক্যাম্পেইনের সহসমন্বয়কারী প্রমুন্ডো রিপোর্টটি তৈরি করেছে। এতে ইন্টারন্যাশনাল মেন অ্যান্ড জেন্ডার ইকুয়ালিটি সার্ভে (ইমেজেস), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউনিসেফ এবং ইউএন উইমেনের উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
মহামারির সময় গার্হস্থ্য কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ বাড়াটা ইতিবাচক। তবে পরিবারের সদস্যদের যত্ন, দেখাশোনাসহ ঘরের কাজে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব পালনে সমতা অর্জন থেকে বিশ্ব কমপক্ষে ৯২ বছর দূরে রয়েছে। কোনো দেশ আজ পর্যন্ত এই সমতা অর্জন করতে পারেনি এবং সে জন্য কোনো দেশের নীতি ও লক্ষ্যমাত্রাও নেই।
যখন বাবারা সন্তান পালনে অংশগ্রহণ করেন, তখন নারী ও পুরুষের সম্পর্কের প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। কারণ, তখন মা ও বাবা উভয়ই সন্তানদের জন্য আরও সময় পান, নারীরা কাজের ‘দ্বিগুণ বোঝা’ থেকে মুক্ত হন এবং বাবারা সন্তানদের যত্ন নেওয়ার আনন্দ, সন্তুষ্টি ও চাপ অনুভব করেন। সন্তানদের বেড়ে ওঠায় অংশগ্রহণ করা পুরুষদের পৌরুষ ও পিতৃত্বের সংকীর্ণ ধারণা থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে এবং শিশুদের সামনে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে বাবারা দীর্ঘজীবী হন, কম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন এবং তাঁরা সাধারণত সুখী।
স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফাদারস ২০১৯-এর রিপোর্টে ‘হেল্পিং ড্যাডস কেয়ার’-এর তথ্য আছে। সাতটি মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশে ৮৫ শতাংশ পুরুষ জানিয়েছেন যে তাঁরা নবজাতক বা দত্তক নেওয়া শিশুর যত্নের প্রাথমিক পর্যায়ে ‘খুব জড়িত হওয়ার জন্য যা যা করতে হয়, তা করবেন’। কেন পুরুষদের পক্ষে সন্তান পালন ও ঘরের কাজে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না? অর্থনৈতিক নীতিগুলো সাম্যের চেয়ে আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও মুনাফাকে প্রাধান্য দেয় এবং যে কাজে বেতন নেই, তাকে গুরুত্বহীন মনে করে। গার্হস্থ্য কাজ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী ও মেয়েদের দায়িত্ব বলে পরিচিত এবং উপার্জন করাকে পুরুষদের কাজ হিসেবে দেখা হয়। শত বছরের নীতি, কর্মক্ষেত্রের চর্চা, গণমাধ্যম ও শিক্ষা পাঠ্যক্রমও এই ধারণাকেই শক্তিশালী করেছে। এমনকি যখন নারীরা ক্রমবর্ধমান হারে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করছেন, তখনো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি। রাষ্ট্র ও পরিবার পুরুষদের আয় করাকে অগ্রাধিকার দেয়, নারীদের পেশাগত কাজকে উৎসাহিত করে না এবং বেতনহীন যত্ন ও দেখাশোনার দায়িত্বকে অবমূল্যায়ন করে।
আমরা সবাই এমন বাংলাদেশি নারীদের সঙ্গে পরিচিত, যাঁরা বিয়ে ও সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন বা উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ নিতে পারেন না। যখন অনেক নারী সন্তান পালন, ঘরকন্নার সব দায়িত্ব পালন, পরিবারের প্রবীণ ও অসুস্থ সদস্যদের সেবা করেন, তখনো বলা হয় যে তাঁরা ‘কাজ’ করছেন না! এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
সন্তানদের বেড়ে ওঠায় অংশগ্রহণ করা পুরুষদের পৌরুষ ও পিতৃত্বের সংকীর্ণ ধারণা থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে এবং শিশুদের সামনে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। সন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে বাবারা দীর্ঘজীবী হন, কম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন এবং তাঁরা সাধারণত সুখী।
এই বছরের স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফাদারস রিপোর্টে সাতটি সুপারিশ করা হয়েছে:
১. পরিবারের সদস্যদের যত্ন ও দেখাশোনার কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে এই কাজের পুনর্বণ্টন করে জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এতে ব্যক্তিগত ও সরকারি পর্যায়ে দায়িত্ব স্পষ্ট করতে হবে।
২. কর্মজীবী মা ও বাবা উভয়কে সন্তান বড় করার জন্য সবেতন ছুটি দিতে হবে।
৩. সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সময় নারী ও পুরুষের মধ্যে ঘরের কাজ সমানভাবে ভাগ করতে হবে।
৪. প্রসব–পূর্ব সময় থেকে সন্তানের জন্ম এবং পরে তার বেড়ে ওঠায় বাবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
৫. স্কুল, মিডিয়া ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘরের কাজে পুরুষদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কারণ, এসবের মাধ্যমেই সামাজিক রীতিনীতি তৈরি হয়।
৬. কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও নীতি পরিবর্তন করে কর্মীদের সন্তান পালন ও গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালনে সহায়তা করতে হবে। জাতীয় আইনে এর প্রতিফলন থাকতে হবে।
৭. যত্ন ও দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নীতিগুলোকে সমর্থন দেওয়ার জন্য পুরুষ রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনীতিতে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য কাজ করে যেতে হবে।
সুইডেনে নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। পড়াশোনা ও কর্মসূত্রে বেশ কিছু সুইডিশ পুরুষকে জেনেছি। বেড়ে ওঠার সময় তাঁদের জীবনে মা-বাবার সমান ভূমিকা ছিল এবং উভয়ে পেশাগত কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে তাঁরা শৈশব থেকেই নারী-পুরুষের সম্পর্কে সমতার গুরুত্ব শিখেছেন এবং নিজেদের জীবনে চর্চা করেন। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
জরিপে বাংলাদেশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তবে সুপারিশগুলো আমাদের জন্য প্রযোজ্য। সন্তানদের বেড়ে ওঠা এবং প্রাথমিক বিকাশে বাবাদের সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করবে, এমন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলোর মধ্যে আছে পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করা, সন্তান পালন যে মা-বাবার যৌথ দায়িত্ব, এটি হবে তার স্বীকৃতি। কর্মক্ষেত্রে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নারী ও পুরুষ উভয়ই পেশাগত দায়িত্ব এবং সন্তান পালনসহ ঘরকন্নার কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারেন। মা-বাবার উচিত ছেলে ও মেয়েশিশুদের সমানভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা, যাতে তারা নারী ও পুরুষের কাছে সমাজের প্রত্যাশিত আচরণের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ না থাকে। নারী ও পুরুষের ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কোভিড-১৯ আমাদের নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক, পরিবেশগতভাবে টেকসই এবং ন্যায়ভিত্তিক একটি বিশ্ব গড়ার সুযোগ দিয়েছে। সন্তানদের বড় করা এবং ঘরের কাজে পুরুষদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে আমরা সেই বিশ্ব সৃষ্টিতে এগিয়ে যেতে পারি।
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী