Thank you for trying Sticky AMP!!

চলে গেল আমার প্রিয় বন্ধু

খন্দকার মুনীরুজ্জামান (১৯৪৮—২০২০)

সোমবার সন্ধ্যায়ও শুনেছি মুনীর ভালোর দিকে। হাসপাতালে ওর অক্সিজেন মাস্ক বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন মুখে খেতে পারে। ভিডিওতে তার স্ত্রী রেখার সঙ্গে ইশারায় কথাও হয়েছে। আর পরদিন সকালেই জানলাম, সে নেই। একেবারে অচিন্তনীয়।

মুনীর, মানে মুনীরুজ্জামান। দৈনিক সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আমরা কলেজিয়েট স্কুল থেকেই বন্ধু। আমাদের ক্লাসে সে-ই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। সেই ১৯৬২ সাল থেকে। আজ সে নেই। ভাবলেই চোখ ভিজে আসে।

মুনীরের ছিল অসাধারণ ও বহুমাত্রিক গুণ। সে প্রতিদিন স্কুলে এসে বলত, ‘নাজ সিনেমা হলে হাঞ্চ ব্যাক অব নটর ডেম ছবিটা এসেছে। চলো দেখি। অ্যান্থনি কুইনের ছবি। দেখতেই হবে। অথবা স্নোজ অব কিলিমানজারো বা অড্রে হেপবার্নের ছবি। দেখতেই হবে।’ এই বিশ্বখ্যাত ছবিগুলো দেখা আমি শিখেছি মুনীরের কাছে। তার বাসা শান্তিনগর থেকে হেঁটে সদরঘাট মোড়ে আমাদের স্কুলে আসার পথে প্রতি সপ্তাহে নাজ ও গুলিস্তান সিনেমা হলে কী ছবি আসছে, তার খবর সে আমাকে জানাত। সেই থেকে বন্ধুত্ব।

মনে পড়ে, ’৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় বিকেল পাঁচটায় স্কুল ছুটির পর আমরা দুজন একসঙ্গে বের হয়ে হেঁটে যেতাম হোসেনি দালান এলাকায় ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে। ক্লাসের অন্য কয়েকজন বন্ধুও থাকত। তারপর যার যার বাসায়। এভাবে আমরা হলিউড-বলিউডের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। আমাদের বাসায় আগে থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির পরিবেশ ছিল। ভাইবোনেরা ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। আমি সেদিক থেকে আলাদা কিছু না। কিন্তু মুনীর বেশ উৎসাহ নিয়ে এসে গেল। আমরা দুজন এ পর্যন্ত সেই এক সুতায়ই গাঁথা।

ঢাকা কলেজে সেলিম (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সিপিবির সভাপতি), আমি ও মুনীরের একটা ট্রায়ো হলো। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবির সমর্থনে ঢাকায় হরতালের পিকেটিংয়ে নামলাম। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। পুলিশ টপাটপ ধরে নিয়ে যাচ্ছে কর্মীদের। প্রথমেই গ্রেপ্তার হয়ে গেল সেলিম। আমি ও মুনীর গেলাম জজকোর্টে। হাজার হাজার গ্রেপ্তার। কয়েক দিন আদালতে আমরা দুজন ঘোরাঘুরি করলাম অ্যাডভোকেটের পেছনে। কয়েক দিনের মধ্যে সেলিমের জামিন হলো। আমাদের সঙ্গে হেলাল (মুহাম্মদ হিলালউদ্দিন,এখন মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টের একজন পরিচালক), স্কুলের বন্ধু সোহরাবও ছিল। আমরা তখন থেকেই রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ি।

একজন মুক্তিযোদ্ধা। ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত আগরতলা-ঢাকা যাতায়াত করত। আমরা ওপারে। ট্রেনিং, ইনডাকশন, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে। মুনীরের সঙ্গে তখন মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর মুনীর যোগ দিল ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রে। শ্রমিকনেতা হিসেবে পোস্তগোলা ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকায় শ্রমিকদের সংগঠিত ও সচেতন করার জন্য কাজ করত। শ্রমিকনেতা হিসেবে সে সবার পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিল। ঢাকা মহানগর কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক।

ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকে সেলিম ও আমি নিয়মিত মুনীরের শান্তিনগরের বাসায় আড্ডা দিতে যেতাম। চা আর মুড়ি ভাজা চলত। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম বিয়ে করে মুনীর। তার স্ত্রী রেখা একজন ডাক্তার। তখন তাদের বাসা ছিল মালিবাগে। সেখানে আমরা যে কত আড্ডা দিয়েছি, বলার নয়। রেখা ছিল আমাদের বন্ধু। তার রান্না খেয়ে সারা দিন আড্ডা চলত। রেখার ছিল একটি লং প্লে রেকর্ড প্লেয়ার। এই যন্ত্র আমরা সেখানেই প্রথম দেখি। সারা দিন চলত রবীন্দ্রসংগীত। আর ওদিকে রেখার হাতের রান্না খিচুড়ি-মাংস। একটু পরপর চা-বিস্কুট। সেই দিনগুলো আর ফিরে পাব না।

তার লেখার হাত ছিল অসাধারণ। দৈনিক সংবাদ-এ ৮০-৯০-এর দশকে নিয়মিত কলাম লিখত। তার লেখা পড়ার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। কারণ, লেখার মধ্যে যুক্তি ও কঠোর ভাষায় স্বৈরাচারের সমালোচনা থাকত। তার রসবোধ ছিল প্রবল।

পরে সে সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়। সে ছিল আমাদের গর্ব।

তার এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য খুব কষ্টের। মুনীর চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে শেখার মতো অনেক কিছু। তার স্মৃতি চির–অম্লান থাকবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো