‘যা, আজ থেকে তোর ভাত বন্ধ!’—এই হুমকি অতি প্রাচীন। এই ধমকি ঐতিহ্যসিক্ত। এর সঙ্গে নিখিল বঙ্গ বখাটে সম্প্রদায়ের পরিচয় খুব নিবিড়। একসময় গ্রামবাংলার আটপৌরে মা-বাপেরা বেয়াড়া পোলাপান লাইনে আনতে এই হুমকি দিতেন। গেরস্ত তার বাড়িতে পেটে-ভাতে থাকা চাকরবাকরকে এই ধমকি দিতেন। এতে কাজও হতো কোরামিনের মতো।
একটা সময় ছিল যখন অন্নদাতার মুখে ভাত বন্ধের হুমকি শুনতে হয়নি এমন বখাটে বাটিচালান দিয়েও খুঁজে পাওয়া যেত না। ভাত বন্ধের আশু আশঙ্কায় অবাধ্য সন্তান নলের মতো সোজা হয়ে যেত। ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ শুনে রুটিখোর ইয়াহিয়ার পর্যন্ত কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। কর্তব্যনিষ্ঠ দাগি বখাটেদের কথা অবশ্য আলাদা। তারা অতিবিপ্লবী হাভাতে; তাদের কাছে এই হুমকি বরাবরই জলভাত। তারা সারমেয় পুচ্ছ; তারা সোজা হওয়ার নয়। বাপ-মা ভাত বন্ধের হুমকি দিলে তারা বলে, ‘খাইলাম না তুমার ভাত; আমি রুটি খাব।’
বছর বিশেক আগেও গ্রামে-গঞ্জে ভিক্ষুকেরা প্রকৃতই ভিক্ষুক ছিলেন। অভাবতাড়িত স্বভাবে তাঁরা ছিলেন মাধুকরী। তাঁরা টাকাপয়সা চাওয়ার সাহস পেতেন না। ‘মা কয়ডা ভাত দ্যান’ বলে তাঁরা বাড়ির দরজায় টোকা দিতেন। পেট ভরা থাকলে ভয়ে ভয়ে অতি কাতর গলায় বলতেন, ‘চাইরডা খয়রাত দ্যান’। তাঁদের মলিন থলেতে বাড়ির লোক এসে ‘চাইরডা খয়রাত’ হিসেবে এক মুঠো, কোনো কোনো সময় আধা মুঠো চাল ঢেলে দিত।
ভাত তখন দামি জিনিস ছিল। দুধ-ভাত ছিল চূড়ান্ত সমৃদ্ধির প্রতীক। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে মাঝি ঈশ্বরীকে দিয়ে বলিয়েছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। মাঝি ঈশ্বরী তো বলতে পারতেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে পিৎজা-বার্গারে’। তা তিনি বলেননি। মানে পিৎজা-বার্গারের ধারণাই তাঁর ছিল না। দুধ-ভাতের চেয়ে সমৃদ্ধ আর কোনো প্রতীক ভারতচন্দ্র কল্পনায় আনতে পারেননি।
দিন বদলেছে। গত এক দশকে বাংলার আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রগতি হয়েছে। পাবলিকের ট্যাঁকে পয়সাকড়ি কিছু এসেছে। এখন আর তারা আগের মতো ভেতো বাঙালি না। সকালবেলায় তারা চায়ের মধ্যে টোস্ট বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া শিখেছে। স্যান্ডউইচ-বার্গার-চিকেন ফ্রাই মাঝেমধ্যেই খাওয়া পড়ছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শণের ঘরের জায়গায় টিনের ঘর; টিনের ঘরের জায়গায় দালান উঠেছে। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন; হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ভিক্ষুকেরা এখন আর ‘চাইরডা ভাত’ চান না। ভাত দিতে চাইলে তাঁদের সম্মানে লাগে। সিকি, আট আনা তো দূরের কথা; এক টাকার নোট প্রায় জাদুঘরে গেছে। দুই টাকার নোট পেয়েও ভিক্ষুকদের মুখে হাসির ঝিলিক খেলে না। একসময় অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা বাড়িতে কাজের লোক রাখতেন। সেই কাজের লোক থাকত ‘পেটে-ভাতে’। বেতনকড়ির ব্যাপার ছিল না। এখন ‘পেটে-ভাতের’ পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা বেতন দিয়েও কাজের লোক পাওয়া যায় না। এই আর্থসামাজিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে অবাধ্য সন্তানকে এখন বাবা-মায়ের পক্ষে ‘আজ থেকে তোর ভাত বন্ধ’ বলা লজ্জার ব্যাপার; আত্মমর্যাদাহানির ব্যাপার।
কিন্তু দিন বোধ হয় ‘পল্টি’ খাচ্ছে। ভাত বোধ হয় আবার তার হৃত সম্মান পেতে চলেছে। কারণ, চাল নিয়ে চালাচালি শুরু হয়েছে। চুলোচুলি ‘হব হব’ করছে। মনে হচ্ছে, ‘আজ থেকে তোর ভাত বন্ধ’—এই ঐতিহ্যবাহী জালালি হুমকি তার বনেদি বংশমর্যাদা ফিরে পেতে চলেছে। বোঝা যাচ্ছে, হাভাতে বখাটেদের সামনে খুব খারাপ দিন। উঠতে-বসতে তাদের ভাতের খোঁটা শুনতে হবে।
গত কয়দিনে চালের বাজারে আগুন ধরেছে। ‘বাজারে অগ্নিকাণ্ড’ ঘটেছে না বলে ‘বাজার এখন অগ্নিকুণ্ড’ বললে কথাটা বেশ ফিট হয়। মোটা চালও ৫০ টাকার ওপরে। চিকন চালের দাম ৬০ টাকার ওপরে। সরকার বলছে, দেশে এমন কোনো ঘাটতি হয়নি যে দাম এইভাবে বাড়বে।
এই দেশে ধান থেকে চাল হয়; চাল থেকে মজুতদারেরা লাল হয়; আর কৃষকেরা কী হয় সেটা বলতে লজ্জা লাগছে।
দুজন মন্ত্রী বলে দিয়েছেন, সব মিল মালিকদের বুজরুকি। চালকল মালিকদের সমিতির সভাপতির মিলে অভিযানও চালানো হয়েছে। মিল মালিকেরা বলেছেন, তাঁরা নিমিত্তমাত্র; আসলে দাম বাড়িয়েছে মিডিয়া। কাদা ছোড়াছুড়িতে বরাবরই আমরা ওস্তাদ। সেটাই আমরা করছি। কিন্তু আদতে গুদামের ধান সেদ্ধ-শুকনোর জন্য চাতাল পর্যন্ত আসছে না। সেগুলো মজুতদারের গোপন গুদামে ঘুমাচ্ছে। চাল শ্রমিকেরা আপাতত শূন্য চাতালে মাতাল হয়ে পল্লিগীতির চর্চা করছে।
এবার বন্যায় ধানের ফলন মার খেয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। সব মিলিয়ে দাম যা বেড়েছে তাতে গরিব মানুষের বড়লোকি চাল শেষ। চাল কিনতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। মধ্যবিত্তের ফাস্ট ফুডের ‘ফুটানি’ ধরে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন আতপ চাল আনছে। ওএমএসে চাল বিক্রি শুরু করেছে। মোটা আতপ ৩০ টাকা এবং আটা ১৭ টাকা কেজি। মানে বাজারের চেয়ে কেজিতে অন্তত ২২ টাকা কম দাম। এরপরও কাস্টমার নাই। একে তো আতপ, তার ওপর মিয়ানমারফেরত। এই চাল গলা দিয়ে নামা শক্ত। টেলিভিশনে দেখলাম একজন বলছেন, ‘এইটা আতপ চাইল। এই চাইলের ভাত খামু না।’ মনে মনে বলছিলাম, ‘আরে বাবা, খাবা না ক্যান? এত কম দাম! আতপ চাইল কি চাইল না?’ কাস্টমাররা বলছে, আতপ চালের ভাতে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। পাইলসের রোগী হলে আর রক্ষা নাই। কিন্তু কাস্টমার এটা বুঝতে পারছে না, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’।
আলোচ্য অংশটুকু বোঝাতে গিয়ে আমাদের খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ‘এই আতপ চালের মান খুবই ভালো। শুরুতে ক্রেতারা এটা বুঝতে পারছে না। দু-তিন দিনের মধ্যে ক্রেতারা এই চাল বেশি বেশি করে কিনবে। তারাই বলবে এটা অনেক ভালো চাল।’ যারা আতপ নিতে চায় না, সেদ্ধ চাল চায়, তাদের জন্য কোনো সুযোগ রাখা হবে কি না—জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই আতপ চালই মানুষ খুঁজে খুঁজে কিনবে। ওএমএসে সেদ্ধ চাল দেওয়া যাবে কি না, তা এখনই আমি বলতে পারব না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী মিলমালিক তথা চাল মজুতদারদের গ্রেপ্তারের কথা বলেছেন। আর মিল মালিকেরা সব দায় মিডিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। কাজের কাজ হিসেবে হু হু করে দাম বাড়ছে।
এখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় খাদ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে জমিদারি চাল ছেড়ে দিয়ে আতপ চালে অভ্যস্ত হতে হবে; নয়তো পেটের ক্ষুধার কথা বাদ দিয়ে চোখের ক্ষুধা কিংবা মনের ক্ষুধার কথা বলতে হবে।
আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত কবি। সেই হিসেবে আমি পেটের ক্ষুধার কথা বাদ দিয়ে আপাতত চোখের ক্ষুধার কথা বলতে চাই। ওএমএসের ট্রাক থেকে ঝরা চাল কুড়ানো বাদ দিয়ে মনের বিরান বাগানে যতীন বাগচীর ‘অন্ধ বধূ’র মতো ঝরা বকুল কুড়াতে চাই। চাল কিনতে মিয়ানমারে যাওয়ার চেয়ে আপাতত সাহিত্যের সওদা কিনতে বনলতার ডাগর চোখে নোঙর ফেলতে চাই। লাবণ্যের গাড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার ধান্দায় শিলং পাহাড়ে ঘুরতে চাই। হিজলীর কেয়াবনে মাঘী পূর্ণিমায় কপালকুণ্ডলার সাথে কথা বলতে চাই। জীবিকানির্ভর জঠরের সাথে ভাবের কোর্ট ম্যারেজ দিয়ে; সোজা কথায় চোখের ক্ষুধা দিয়ে পেটের ক্ষুধা ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু সেখানেও বেহুলার কালরাত্রি। সেখানেও মনসার ফণা। সে বিষ ঝাড়তে পারার মতো মাদার তেরেসা তো নেই।
মানুষের কষ্ট ভুলে থাকতে যে নিদ্রায় ডুবি, সেই ঘুমে দেখা স্বপ্নের জ্যোৎস্না ভাতের ফ্যানের মতো বাসি হয়ে যায়। থাই স্যুপ সেখানে ড্রেনের জঞ্জাল। উপবাসের ক্ষুধিত সাম্রাজ্যে আমাদের ফাটকা ব্যবসায়ী মন পানকৌড়ির মতো ডুবে ডুবে শেয়ার মার্কেটের বেনিফিট খোঁজে।
জীবন একেকজনের কাছে একেক রকম। ডিমের পুডিং আর টিনের চালের পুটিং যেমন এক নয়, তেমনি কবির স্বপ্ন আর ওএমএসের আতপ চাল কিনতে লাইনে দাঁড়ানো শ্রমজীবীর স্বপ্ন এক নয়। জীবন বেয়োনেটের মতো ক্ষুধার্ত। সেই ক্ষুধা নিদারুণ নিষ্ঠুর। অবসরপ্রাপ্ত কবিকেও সে ছাড় দেয় না।