
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের অগ্রগতির জন্য ১৭টি উদ্যোগ ও নীতিমালায় গুরুত্ব আরোপ করেছিল। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে এই উদ্যোগগুলো কীভাবে গৃহীত হয় এবং গৃহীত হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয়ভাবে কী কী পদক্ষেপ আগামী ১৫ বছরে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে গ্রহণ করতে পারি। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে প্রথমেই দারিদ্র্য নিরসনের রূপরেখা আছে। দারিদ্র্যকে শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য এটিই বর্তমান বিশ্বের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার মধ্যে সমন্বয় আছে। আমাদের সরকার দারিদ্র্য বিমোচন ও পুনর্বাসনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে গৃহীত পদক্ষেপে বস্তিবাসীর পুনর্বাসনে রাজধানীতে ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনে পর্যায়ক্রমে ভাড়াভিত্তিক এই আবাসন ফ্ল্যাট নির্মাণ করবে। (তথ্যসূত্র: বাংলাইনসাইডার.কম; ১১ জুন ২০১৭)
সে ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের অপর একটি লক্ষ্য মাথায় রাখতে হবে, যেখানে উল্লেখ আছে, শহরে স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো তৈরি, নতুন অল্প খরচে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এগুলোই টেকসই উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্বল্প খরচের স্থাপনার কথা বলা হয় ঠিকই, কিন্তু দিন শেষে স্থাপনার প্রতি বর্গফুটের মূল্য বাড়ে বৈ কমে না। এমনকি প্রাকৃতিক পরিবেশকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে, যেমন আবাসন প্রকল্পে সঠিক পন্থায় আলো-বাতাস চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, তা না হলে জনসাধারণের মাসিক বৈদ্যুতিক খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ফলে তা বস্তিবাসীর হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
স্থাপনাগুলোর নকশা এমনও হতে পারে, যেন প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে ছোট পরিসরে সবজি চাষের ব্যবস্থা থাকে, যা বর্তমানে চীনসহ উন্নত অনেক শহরেই দেখা যাচ্ছে। কারণ, প্রথমেই দেখতে হবে, যাদের জন্য স্থাপনাটি তৈরি হচ্ছে, তাদের কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে কি না। কিংবা এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, অধিক মানুষের বসবাসের জন্য আবাসন প্রকল্পটি অনেক ঘিঞ্জি করে তৈরি করা হচ্ছে, তা ছাড়া ব্যবহার এবং অভ্যাসগত কারণে অনেকেই পরিবেশ দূষিত করে ফেলে।
এ অবস্থায়, বিশেষ কিছু নীতির মাধ্যমে তাদের এমনভাবে কর্মক্ষেত্রে সুসংগঠিত করতে হবে, যেন নিজেদের প্রয়োজনে তারা আবাসস্থল সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে, যার প্রভাব আশপাশের সমাজে পড়বে না। এসব স্থাপনায় শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে সবার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য কিছু সামাজিক জায়গা বরাদ্দ করার বিশেষ ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন। অতীতেও দেখা গেছে, বিদেশি কিংবা দেশীয় অর্থায়নে স্বল্পমূল্যের এসব আবাসনের নামে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অব্যবস্থাপনা চলেছে। অপরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত লাভের আশায় ব্যবসার ফাঁদ পাতা হয়েছে; যার মূল্য সরকারকেই দিতে হয়েছে।
অনেক সময় এ ধরনের স্থাপনার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা এবং আশপাশের বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতে পারে, যার উদাহরণ বিশ্বের অনেক শহরেই বিদ্যমান। সে ক্ষেত্রে তারা প্রধান শহরের বাইরে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান তৈরি করে সেখানে তাদের আবাসন গড়ে তুলেছে, যার দরুন তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার ব্যয়ভার শহরের তুলনায় অনেকাংশেই কমে গেছে। ব্যাপারটা তাদের জন্য লাভজনক। তা ছাড়া বর্তমানে অতি উচ্চ জনঘনত্বের ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ ধরনের অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আবাসন প্রকল্প আদৌ শহরের সামগ্রিক উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সেটা না হলে এই প্রকল্প শহরের বাইরে হওয়াই বেশি যৌক্তিক, সে ব্যাপারে আরও বেশি সমীক্ষার প্রয়োজন আছে কি না, তা–ও যাচাই করা দরকার।
এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সরকারকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন। কারণ, এমন একটি স্থাপনায় বসবাসকারীরা যেন সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করতে পারে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যেন সামাজিক অবক্ষয় না হয়, সেটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশই এ ধরনের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে শহরকেন্দ্রিক সামাজিক অপরাধ ও অবক্ষয়ের শিকার হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে সামাজিক নিরাপত্তার খাতিরে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস, মিজৌরিতে প্রুয়েৎ-ইগোআবাসন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। স্থানের বিষয়টি শহরকেন্দ্রিক টেকসই উন্নয়নের দিক থেকে আবারও পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে এর কোনো সামাজিক প্রভাব বস্তিবাসীসহ সাধারণ জনগণের মধ্যে যেন না পড়ে, সেভাবেই টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের সামগ্রিকভাবে পুনর্বাসন করে দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। এটিই হবে আমাদের জন্য ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি।
অলাভজনক ব্যবসা ও টেকসই উন্নয়ন কমিশন থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার শহরগুলো টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সব থেকে বড় সুবিধা পেতে যাচ্ছে। এশিয়ার শহরগুলোতে যদি সবুজ ও টেকসই উন্নয়নের বৃদ্ধির পূর্বাভাস সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়, তাহলে অঞ্চলভেদে লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ধারণা করা হচ্ছে, বছরে লাভ হবে প্রায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই সঙ্গে শহরগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেড়ে উঠবে।
কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য স্থানীয় সরকারসহ অন্যান্য বিনিয়োগকারীকে কর্মপরিকল্পনায় আরও বেশি সংগঠিত এবং সবুজ প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীলতা ও ব্যবসায় সততা বাড়াতে হবে। উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী অবকাঠামো থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়, তার রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।