Thank you for trying Sticky AMP!!

তিউনিসিয়ার নির্বাচন: তরুণেরা নতুনকে চায়

প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের পেছনে ফেলে প্রথম দফার নির্বাচনে প্রথম হয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ কাইস সাইয়িদ এবং দ্বিতীয় হয়েছেন মিডিয়া মোগল নাবিল কারুরি। ছবি: এএফপি

তিউনিসিয়ায় আবার বিপ্লব। বিজয় হয়েছে জনতার আর বিপ্লবের কারিগর—২০১১–এর মতো এবারও তরুণেরা। তরুণ ভোটারদের সমর্থনে গত রোববারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের হটিয়ে অচেনা নবীন দুই প্রার্থীর এগিয়ে থাকা বোঝায়, তরুণেরা সত্যিই পরিবর্তন চায়। এই জয় তিউনিসিয়ায় দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বৃত্তে ফাটল ধরিয়েছে। এই ভাঙাগড়ার মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ২০১১ সালের বিপ্লবের মূলমন্ত্রের পুনরাবির্ভাব দেখছেন। একই সঙ্গে ট্রাম্প, মোদি ও পুতিনের জনতুষ্টিবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের ধাক্কায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যাত্রা যখন উল্টো পথে, তখন তিউনিসিয়ায় নির্বাচন গণতন্ত্রমনাদের জন্য আশাপ্রদ।

এ নির্বাচনে অচেনা মুখ, আইনের অধ্যাপক সংবিধান বিশেষজ্ঞ কাইস সাইয়িদ ১৯ শতাংশ আর মিডিয়া মোগল নাবিল কারুরি ১৬ শতাংশ ভোট পেয়ে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ইসলামপন্থী দল আন নাহদার আবদেল ফাত্তাহ মৌর ১৩ আর সেক্যুলার নিদা তুনিসের আবদেল করিম জিবিদি ১১ শতাংশ ভোট পেয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখল করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ চাহেদ শুরুর দিকে সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও ভোটে ভালো করতে পারেননি। মিডিয়া মোগল নাবিল কারুরির জনপরিসরে পরিচিতি থাকলেও কাইস সাইয়িদ ছিলেন একদমই অচেনা। নির্বাচন–পরবর্তী সব জরিপের ভাষ্যে দুই প্রার্থীই বিপ্লবী এবং বিপ্লব–পরবর্তী প্রজন্মের—যাঁদের বয়স এখন ১৮ থেকে ৩০—ভোট পেয়েছেন।

২০১১ সালের বিপ্লব ছিল স্বৈরাচার বেন আলীর বিরুদ্ধে। আর এই বিপ্লব সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীদের জোটের বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে জনতার আছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিপ্লবের মূলমন্ত্রকে দাবিয়ে রাখার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিপ্লব–পরবর্তী ২০১৪ সালের প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের পর থেকে ইসলামপন্থী ও সেক্যুলারদের জোট রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েই সময় খরচ করেছে। কথা বলেছে পুরোনো ইসলামি বিধান আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিক অথবা উপযুক্ত কি না, তা নিয়ে। জনমানুষের দৈনন্দিন সমস্যা তথা অর্থনীতি, বেকারত্ব, নিরাপত্তা নিয়ে সামান্যই কথা হয়েছে।

নির্বাচনের আগের হিসাবে প্রায় ১৬ শতাংশ মানুষ বেকার ছিল। জনসাধারণ রাস্তায় নেমেছে, বিক্ষোভ অবরোধ করেছে, কিন্তু সরকারের কর্তাদের লোহার গেট ভাঙতে পারেনি। তাই ভোটের রাজনীতিতে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছিল অনিবার্য। ২০১৮ স্থানীয় নির্বাচনে এই পরিবর্তনের বার্তা ছিল স্পষ্ট। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩৩, নাহদা ২৯ আর নিদা তুনিস ২৩ শতাংশ ভোট পান। তিউনিসিয়ার ইতিহাসে এর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এত ভোট কখনোই পাননি। স্থানীয় ওই নির্বাচনে হতাশাপূর্ণ ফলাফল ও নাহদা আর নিদা তুনিসকে সর্বব্যাপী কল্যাণের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেনি বরং উভয় দলই আদর্শিক রাজনীতির মধ্যে ক্ষমতার তালাশ করেছে।

প্রধান দুই দলের ব্যর্থতার জায়গাগুলো শনাক্ত করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন সাইয়িদ। গণমানুষের চাওয়া ছিল অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ, ছোট শহরগুলোয় অর্থনৈতিক জোনের প্রতিষ্ঠা আর গ্রামাঞ্চলে কৃষির জন্যও পর্যাপ্ত সেচের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা। সাইয়িদ তাঁর প্রতিটি জনসভাতেই এই বিষয়গুলো তুলে ধরে সমাধানের পথও বর্ণনা করেছেন। নিজেকে প্রথাগত রাজনীতির জঞ্জাল থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। সামাজিক সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দেওয়ার এ আশ্বাসে বিশ্বাস রেখেছে ভোটারদের বড় অংশ। সাইয়িদের ছিল না বড় কোনো জনসভার আয়োজন, ছিল না ব্যাপক পরিচিতি আর মিডিয়ার একক সমর্থন। তবে ছিল যুবসমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন। হাজার হাজার যুবক স্বপ্রণোদিত হয়ে সাইয়িদের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজ করেছেন। যুবকদের কল্যাণেই ফেসবুক আর টুইটার ছিল সাইয়িদের দখলে। তবে সাইয়িদের নির্বাচনী প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নিজেকে স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা। সে ক্ষেত্রে অনেকটা সফলও তিনি। সাইয়িদ গণমানুষকে বোঝাতে পেরেছেন যে তিউনিসিয়ায় অর্থনীতি ও রাজনীতিকে অভিজাতদের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র ভরসাস্থল তিনি।

তবে মিডিয়া মোগল নাবিল কারুরির গল্প ভিন্ন। তিউনিসীয় সমাজে নাবিলের মানবসেবার খ্যাতি বেশ পুরোনো। সেই পুরোনো খ্যাতি দিয়ে এবার তিনি রাজনৈতিক খ্যাতি অর্জন করলেন। নির্দিষ্ট বেশ কিছু বিষয় এই রাজনৈতিক খ্যাতি অর্জনে নাবিলকে সাহায্য করেছে। প্রথমত, পশ্চিমাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক—বিশেষ করে ফ্রান্সের সঙ্গে। নিন্দুকেরা নাবিলকে তিউনিসিয়ার রাজনীতিতে ফ্রান্সের সফল একটি প্রকল্প হিসেবেই দেখেন। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগমুহূর্তে অর্থ পাচার আর কর ফাঁকির অভিযোগে নাবিলের গ্রেপ্তার হওয়া। এই আটক হওয়া নির্বাচনে নাবিলকে দ্বিতীয় স্থান পাইয়ে দিয়েছে বলে মনে করে অনেকেই—বিশেষ করে নিদা তুনিসের সমর্থকেরা। জেলে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা করেন নাবিল, নিজেকে উপস্থাপন করেন রাজনৈতিক দলগুলার প্রতিশোধমূলক নিপীড়নের শিকার বলে। এই প্রচারণা সেক্যুলার আর ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে মানুষের অবিশ্বাসকে আরও বেশি মজবুত করে। অবিশ্বাসের মধ্যেই নির্বাচনের আগমুহূর্তে নাবিলের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল, নেসামায় সরকারের চক্রান্তের স্বীকার বলে নাবিলের পক্ষে বিরামহীন প্রচারণা চালিয়ে নাবিলকে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে দেয়।

প্রধান দুই দলই এখন পর্যন্ত ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যেসব সমস্যার কারণে তিউনিসিয়া থেকে আরব জাগরণের শুরু হয়েছিল, তার কিছুই তারা গত আট বছরে সমাধান করতে পারেনি। কে প্রেসিডেন্ট হবেন, তা নিশ্চিত না হলেও এটা নিশ্চিত যে নতুন দুই প্রার্থীই দ্বিতীয় দফা চূড়ান্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

রাহুল আনজুম: ইস্তাম্বুলে বসবাসরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী