Thank you for trying Sticky AMP!!

নির্বাচন যখন নির্বাসনে

২০ সেপ্টেম্বর দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৬০ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জন প্রার্থী জিতেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৯টি পৌরসভার মধ্যে ৩টিতে মেয়রও হয়েছেন একই কায়দায়। সংবিধানে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিটি স্তরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত বা বাছাই করার কথা বলা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লোকই নেই। যে দেশে স্বামী-স্ত্রী, বাবা-ছেলে, জামাই-শ্বশুর একই পদে ভোটযুদ্ধে নামেন, সে দেশে এ রকম অবাক করা কাণ্ড কী করে ঘটল?

বরাবরের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের দায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একে অপরকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু যাঁদের জন্য ভোট, সেই আমজনতার পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, বিএনপি ভোট বর্জন করেছে বলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি মাঠে থাকলে উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট হতো। বিএনপির নেতাদের দাবি, নির্বাচন এলেই তাঁদের নেতা-কর্মীদের নামে পাইকারি মামলা দেওয়া হয়। জেলে পাঠানো হয়। পোলিং এজেন্টদের বাড়িছাড়া করা হয়। এ অবস্থায় কারও পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

বাস্তবতা হলো জাতীয় কিংবা স্থানীয় সব নির্বাচনেই পক্ষ-বিপক্ষ আওয়ামী লীগ। মারামারি–কাটাকাটি তা–ও আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে। আক্রমণকারী ও আক্রান্ত একই দলের। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কিছুটা স্বস্তিবোধ করতে পারেন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কতজন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কতজন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, কতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সুস্থতার লক্ষণ নয়। অনেক স্থানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর অবস্থান ৩ অথবা ৪ নম্বরে। একটি উদাহরণ দিই। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিশাখা সাহা। তিনি অটোরিকশা প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ৭০৩ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়দেব কুমার সাহা পেয়েছেন ২ হাজার ২৬৭ ভোট। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ শামছুদ্দীন আল মাসুদ নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ৭১৩ ভোট। এই হলো দলের প্রার্থী বাছাইয়ের বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যকার সংঘাতে অন্তত দুজন মারা যাওয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, প্রার্থীরা আবেগপ্রবণ হয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, এটি আবেগপ্রবণ নির্বাচন। মানুষ মাত্রই আবেগ আছে। তবে সেই আবেগ কারও জীবনহানির কারণ হতে পারে না।

২০ সেপ্টেম্বর ১৬০ ইউনিয়ন পরিষদ ও ৯ পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচন কমিশনের দাবি, ইউনিয়ন পরিষদে ইভিএমে প্রায় ৫০ শতাংশ, পৌরসভায় ৫৫ শতাংশ ও ব্যালটের মাধ্যমে ইউপি নির্বাচনে ৬৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। সত্যি সত্যি উল্লিখিত সংখ্যক ভোটার কেন্দ্রে গেছেন কি না, সেই প্রশ্ন অনেকেই করছেন। এর আগে জাতীয় নির্বাচনেও আমরা দেখেছি, দিনভর ভোটকেন্দ্র ফাঁকা থাকলেও রাতে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রার্থীর পক্ষে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পাইয়ে দিয়েছে। নূরুল হুদা কমিশনের কেরামতিই বটে!

বরাবরের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের দায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে বাগ্‌যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একে অপরকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু যাঁদের জন্য ভোট, সেই আমজনতার পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনকে অশনিসংকেত বলে অভিহিত করেছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থীদের নির্বাচিত বলা যায় কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। আমাদের দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেওয়ার বহু নজির আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এলাকার বড় ভাই নেতা ঠিক করে দেন কে প্রার্থী হবেন, কে হবেন না; কোন ইউনিয়ন বা উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, কোন ইউনিয়ন বা উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। এভাবে কোনো দেশে নির্বাচন হয়েছে বলে জানা নেই। তবে সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে সবই সম্ভব। তাই মাহবুব তালুকদার যাকে অশনিসংকেত বলেছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় আপাতত দেখছি না। মাহবুব তালুকদার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের মীমাংসা হবে না। অতীতে সমঝোতা বা আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার মীমাংসা হয়নি। এক পক্ষের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অন্য পক্ষ জয়ী হয়েছে। ভবিষ্যতে কী হবে?

একতরফা নির্বাচন হলে ভোটাররা তাঁদের পছন্দসই প্রতিনিধি বেছে নিতে পারেন না। ধরুন, কোনো এলাকায় ‘খ’ দলের ৪০ শতাংশ সমর্থক আছে। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এই অজুহাতে তারা নির্বাচন বর্জন করল। এ অবস্থায় সেখানকার ভোটাররা কী করবেন?

আগের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল ফেনী। এবার বাগেরহাট। এলাকার কোনো জগৎ শেঠ মনে করলেন, এলাকায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে তাঁর নেতৃত্ব আরও সংহত হবে। অতএব একটি পদে একজনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন, বেশি নয়। করোনা সংক্রমণের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোটও জায়গা বদল করেছে। তাই দুষ্ট লোকেরা বলেন, গোটা বাংলাদেশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হলে অনেক সাশ্রয় হতো। নির্বাচন কমিশনকে এত লোকবল পুষতে হতো না। এত অফিস, ইভিএম কিছুরই দরকার হতো না। তারা একদিন ভোটের তফসিল ঘোষণা ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন একমাত্র প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিলেই সাংবিধানিক কর্তব্য সম্পন্ন হতো।

এ তো গেল স্থানীয় নির্বাচন। জাতীয় পর্যায়ের উপনির্বাচন নিয়েও একের পর এক অঘটন ঘটছে। কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। বিএনপি আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত প্রার্থী লুৎফর রেজা মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এলাকায় গিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘এই আসনে সুষ্ঠু ভোট হবে, জনগণের রায় আমি মেনে নেব।’ তারপর কোথা থেকে কী হলো, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া সবাই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেন, যাঁদের মধ্যে জাতীয় পার্টির লুৎফর রেজাও আছেন। তিনি দলের নেতৃত্বকে না জানিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকের ধারণা, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়ে লুৎফর রেজা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এ জন্য জাতীয় পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। দলের চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, লুৎফর রেজাকে প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিলুপ্ত করা হয়েছে দলের কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটিও। বহিষ্কৃত লুৎফর রেজা দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ছিলেন। এর আগে কুমিল্লা-৫ আসনে সাবেক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর শূন্য আসনেও একই ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন জসিমউদ্দিন। শেষ মুহূর্তে তিনিও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন কেবল স্থানীয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও হচ্ছে, যা আমাদের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কথা মনে করিয়ে দেয়। বিবেকের তাড়নায় কি না জানি না, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মাঝেমধ্যে সত্য কথা বলেন। কয়েক দিন আগে তিনি বললেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠবস করেন। ইউপি নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলো, নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়নি। কিন্তু নির্বাচনটি পুরোপুরি সুষ্ঠু করতে কী করণীয়, তা-ও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অজানা নয়। সমস্যা হলো বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com