আমরা এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে ভার্চ্যুয়াল লাইফ কিংবা অনলাইন জগৎকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমাদের জীবনের অনেকটা সময় এখন অনলাইনে কাটাই। কোভিড ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে অনলাইন জগৎ আরও বিস্তৃত হয়েছে পৃথিবীজুড়েই। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করছে অনলাইনে। মানুষজন চাকরি করছে ঘরে বসে অনলাইনেই। ‘হোম অফিস’ টার্মটা এখন মোটামুটি সবার কাছে পরিচিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই আস্তে আস্তে অনলাইন জগতে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে।
অনলাইন কিংবা ভার্চ্যুয়াল জগতের একটা বিশাল অংশজুড়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর মাঝে ফেসবুক এবং টুইটারে পৃথিবীর নানান দেশের মানুষ এখন লম্বা সময় কাটায়। নিজেদের মতামত প্রকাশ করে। যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক জমে ওঠে। বাংলাদেশে অবশ্য ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি এবং দিন দিন সেটা বাড়ছে। সেই সঙ্গে এর জনপ্রিয়তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও নিজদের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ফেসবুক পেজে সংবাদগুলো তুলে ধরছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে খুব সহজেই যে কারও কাছে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে দ্রুততম সময়ের মাঝে।
আমার মনে আছে বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটা গ্রাম থেকে এক ছাত্র আমাকে ফেসবুকে একটি মেসেজ দিয়েছিল। আমি যেহেতু শিক্ষকতা করি; তাই হয়তো সে ভেবেছে আমাকে মেসেজ করে বিষয়টা জেনে নেওয়া যায়। আমি তাকে চিনি না। জানি না। এমনকি সে আমার বন্ধু তালিকাতেও নেই। মাত্রই এইচএসসি পাস করা ছাত্রটি আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল তার আসলে কী করা উচিত। পাশের কোনো কলেজে বিএ কোর্সে ভর্তি হওয়া উচিত, নাকি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চেষ্টা করা উচিত। সে এটা জানতে চেয়েছে; কারণ তার ধারণা সে খুব একটা ভালো ছাত্র না। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে হয়তো চান্স পাবে না। মাঝখান থেকে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাবে। যেটা তার কাছে নেই। অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে বিভিন্ন শহরে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। তা ছাড়া তার পরিবারে এমন কেউ নেই; যে তাকে এই বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারে। তাই সে আমাকে মেসেজ করে বিষয়টা জানতে চেয়েছে।
আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, কষ্ট হলেও তোমার উচিত হবে দেশের যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব; পরীক্ষা দেওয়া। দেখবে কোথাও না কোথাও হয়তো চান্স হয়ে যাবে। ছেলেটা সেটাই করেছিল এবং দেশের একটা নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে চান্স পেয়ে পড়াশোনা করেছে। অর্থাৎ ছেলেটার জীবন কিছুটা হলেও বদলে গেছে। আমি উত্তর মেরুর ছোট্ট একটি দেশে থাকি। ছেলেটা থাকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থাকাতে তার পক্ষে সরাসরি যোগাযোগ করতে কোনো সমস্যা হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন নানা সুবিধা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে অসুবিধাও আছে। এর মাঝে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অনলাইন বুলিং। যেহেতু যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারছে। যে কেউ যে কারও লেখা পড়তে পারছে। মন্তব্য করতে পারছে। দেখা যাচ্ছে কারও মতের সঙ্গে না মিললে কিংবা কারও প্রতি ক্ষোভ থাকলে মানুষজন যা ইচ্ছা সেটাই মন্তব্য করে ফেলছে। সেই মন্তব্য করতে গিয়ে ক্রমাগত ব্যক্তি আক্রমণ করছে। অশালীন ভাষা ব্যবহার করছে। অনেক সময় এমনকি হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বেড়াচ্ছে।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আলোচনা-সমালোচনা; তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমেই সমাজ এগোয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়। তাই আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক খারাপ কিছু নয়। তবে সেটা করতে গিয়ে কিছু মৌলিক বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
কোনো একটা বিষয়ে যদি মতের অমিল থাকে; তাহলে সমালোচনা করা যাবে। কোনোভাবেই কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না।
কারও প্রতি ক্ষোভ থাকলে; এমনকি সেটাও প্রকাশ করা যেতে পারে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই সবার আছে। কিন্তু সেটা করতে হবে ভাষা সমুন্নত রেখে। কোনোভাবেই অশালীন কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে যারা ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে; তাদের অনেকেই কারও মতের সঙ্গে অমিল হলে প্রথমেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বেড়াচ্ছে। এমনকি সমাজে আমরা যাদের প্রতিষ্ঠিত বলে জানি কিংবা মনে করি; অনেক সময় তারাও এমন ভুল করছে। এতে অন্যরাও সেটা অনুসরণ করছে। দিন দিন এর মাত্রা বেড়েই চলেছে।
আমরা যদি এ নিয়ে এখন থেকেই চিন্তা না করি, তাহলে দেখা যাবে একটা প্রজন্ম দাঁড়িয়ে যাবে, যারা মনে করবে কারও মতের সঙ্গে মিল না হলে অশালীন ভাষায় কথা বলা যায় কিংবা ব্যক্তি আক্রমণ করা যায়। অথচ তাদের জানা উচিত, এই ধরনের আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রচলিত আইনে এর বিচারও চাওয়া যেতে পারে।
শুধু আইন দিয়ে কিংবা আইন শিখিয়ে এর পরিবর্তন করা যাবে না। মূল কাজটা যেমন করতে হবে পারিবারিক শিক্ষা থেকে। যেখানে ছোট থেকেই শেখাতে হবে ভাষা সমুন্নত রেখেও দ্বিমত প্রকাশ করা যায়। ঠিক তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এমন শিক্ষা এখনই চালু করতে হবে। নইলে হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে।
আমাদের স্কুলপর্যায়ে পাঠ্যক্রমে প্রতিটা ক্লাসে আলাদা একটা বিষয় থাকা উচিত, যেখানে শেখাতে হবে প্রশ্ন করে; আলোচনা-সমালোচনা; তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সমাজ এগোয়। তবে কারও মতামতের সঙ্গে না মিললে, কারও কোনো লেখায় বা মতামতে যদি ক্ষোভও থাকে, সেটা প্রকাশ করতে হবে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে। ভাষা সমুন্নত রেখে। কোনোভাবেই কোনো পরিস্থিতেই অশালীন ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না। তাদের শেখাতে হবে, অনলাইন বুলিং একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে।
ড. আমিনুল ইসলাম এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের শিক্ষক
aminul@tlu. ee