Thank you for trying Sticky AMP!!

বনে আগুন লাগানো অধ্যাপক গ্রেপ্তার এবং...

ক্যালিফোর্নিয়ায় এক অধ্যাপককে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, তিনি সিরিয়াল অগ্নিসংযোগকারী। একাধিক দাবানলের সূচনা তিনি করেছেন নিজ হাতে। পুড়ে যাওয়া বনের কাছে দেশলাই এবং আগুন লাগানোর উপকরণ পাওয়া গেছে। একটা নয়, বেশ কটা দাবানলের শুরু যখন এবং যেখানে, সেখানেই ছিলেন এই অধ্যাপক। ছিলেন তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে। এই অধ্যাপকের মুঠোফোনের গতিবিধি অনুসরণ করে এই ভয়াবহ তথ্য উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। একটা অরণ্যে আগুন লাগানোর পর তাঁর গাড়ির চাকা আটকে গেলে তিনি পালাতে পারছিলেন না। এরপর উদ্ধারকারীদের সঙ্গে তিনি রহস্যময় আচরণ করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী স্যাক্রামান্টোতে বর্তমানে আটক আছেন তিনি।

এই অধ্যাপকের নাম গ্যারি স্টিফেন মেনার্ড। আগস্টের ৭ তারিখে ল্যাসেন জাতীয় উদ্যানে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশ আগের আরও ছয়টা দাবানলে অগ্নিসংযোগের জন্য তাঁকে দায়ী করছে। তাঁর গাড়ির নিচে ‘ট্র্যাকিং যন্ত্র’ আগেই লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। এসব দাবানলের অনেকগুলোই ভয়ংকর রূপও নিয়েছিল।

ড. গ্যারি মেনার্ড তিনটি বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নাট্যশিল্প, সমাজবিজ্ঞানে—তিনটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি করেছেন সমাজবিজ্ঞানে। সমাজবিদ্যা, মনোবিদ্যা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের মন, অপরাধবিদ্যা, গণমাধ্যমের মনোবিদ্যা ইত্যাদি তাঁর গবেষণার বিষয়। তিনি পড়াতেন সনোমা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান নিয়ে। গত অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়ে ভদ্রলোকের মানসিক ভারসাম্যহীনতা বিষয়ে।

এই অধ্যাপক অবশ্য অগ্নিসংযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে অপরাধী বা নিরপরাধ বলা যাচ্ছে না। তবে মানুষের মন বিচিত্র। ড. জেকিল ও মিস্টার হাইডের গল্প আমরা জানি। প্রত্যকে মানুষের মধ্যে একটা করে ভালো মানুষ আরেকটা শয়তান আছে। কখনো কখনো ভালো মানুষের ভেতরের শয়তানটা বেরিয়ে আসে। যদি ড. মেনার্ডের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, ড. জেকিলের হাইড রূপটাই আমরা দেখব। তিনটা বিষয়ের মাস্টার্স, পিএইচডি, অপরাধবিজ্ঞানের শিক্ষক বনে বনে আগুন লাগিয়ে বেড়ান! কী ভয়াবহ ঘটনা!

২.

আগুন নিয়ে খেলো না। ছোটবেলা থেকেই কতবার এই কথা আমাদের শুনতে হয়েছে। দেশলাইয়ের কাঠি নিয়ে পাটখড়ি দিয়ে বানানো ‘বোমায়’ অগ্নিসংযোগের খেলা খেলতে গিয়ে বড়দের চপেটাঘাত তো কম খাইনি। তবু বড় মানুষদেরও দেখি, আগুন নিয়ে খেলেন তাঁরা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। একা একা একটা মানুষ যখন কম্পিউটার বা মুঠোফোনের কি-বোর্ডের সামনে বসে, ভেতরে মিস্টার হাইড বেরিয়ে আসে। এমন স্ট্যাটাস লিখে বসে, যা দিয়ে একটা মানুষের জীবনের সব অর্জন শেষ হয়ে যায়, কখনো কখনো বড় দাঙ্গা বেধে যায়, মানুষের ঘরবাড়ি-উপাসনালয়ে হামলা হয়! আমি নিজেকে বলি, কলম শব্দটা এসেছে কালাম থেকে। খুবই পবিত্র জিনিস হলো কলম। এটা ভালো কাজে ব্যবহার করতে হবে। আলো ছড়ানোর জন্য, ভালোবাসা ছড়ানোর জন্য, ইতিবাচকতা প্রতিষ্ঠার জন্য। কদর্যতা, অসূয়া, মানহানি, দাঙ্গা, হিংসা ছড়ানোর জন্য যেন আমি আমার কলমকে ব্যবহার না করি।

৩.

জ্ঞানী লোকেরা বদমায়েশি করলে তা বড় ভয়ংকর হয়ে ওঠে। দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে বহু খারাপ কাজের পেছনে তথাকথিত শিক্ষিতজনকেই পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন। আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান—করাপশন। খাদ্য কিনতে যান—করাপশন। জিনিস কিনতে যান—করাপশন। বিদেশে গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না। মানুষকে একদিন মরতে হবে। কবরে যেতে হবে। কিছুই সে নিয়ে যাবে না। তবু মানুষ ভুলে যায় কী করে এ অন্যায় কাজ করতে পারে।’

৪.

জ্ঞানী লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। অপরাধ করে। বড় বড় দুর্ভোগের কারণ হয়। আরেকটা ব্যাপার আছে, তা হলো মূর্খের আস্ফালন। আমরা জানি, নলেজ ইজ পাওয়ার। জ্ঞানই শক্তি। গণিতের সমীকরণে এটাকে সহজেই উল্টে বলা যায়, পাওয়ার ইজ নলেজ। ক্ষমতাই জ্ঞান। যাঁর ক্ষমতা আছে, তিনি যা বলেন, তা-ই জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। সেটাকেই সত্য বলে মেনে নিয়ে চলতে হয়। এই রকম একটা মূর্খের আস্ফালন আমাদের দেখিয়েছিলেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি প্রথমে বললেন, করোনাভাইরাস ভুয়া জিনিস। তারপর হাতে একটা ওষুধ নিয়ে তিনি দেখালেন, এই যে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আমার হাতে। কোনো সাবধানতা লাগবে না। করোনা-টরোনা সব ভুয়া। এখন তিনি এবং তাঁর মতো মানুষেরা বলছেন, মাস্ক পরতে হবে না। টিকা নিতে হবে না। ফেসবুক টিকাবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরেকটা ভয়াবহ বিজ্ঞানবিরোধী অবস্থান ছিল, তিনি বলতেন জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ভুয়া ব্যাপার। এসবকে পাত্তা দিতে হবে না। আমেরিকা জলবায়ুর পরিবর্তনরোধী জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু সারা পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞানী এখন মেনে নিয়েছেন, পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। গত দেড় শ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এবং তা হয়েছে মানুষের কারণে। শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ কয়লা পুড়িয়েছে, খনিজ জ্বালানি পুড়িয়েছে, এ কারণে বাতাসে কার্বন বেড়ে গেছে। গ্রিনহাউসের মতো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে পৃথিবীর ওপরে। তাপ পৃথিবী পৃষ্ঠে আসছে, বেরিয়ে যেতে পারছে না। পৃথিবী দিন দিন তপ্ত হয়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে, উষ্ণতম দিন আসছে ঘন ঘন, শীতলতম দিন কমে যাচ্ছে। গত ১০ বছরেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। এর ফলে তুষার গলছে, হিমবাহ গলছে, সমুদ্রের পানি উঁচু হচ্ছে। আমাদের কক্সবাজারে বা কুয়াকাটায় কয়েক বছর পরপর গিয়ে আমরা নিজেরাই দেখতে পাই, সমুদ্র কীভাবে উপকূল প্লাবিত করে ডাঙার দিকে ধেয়ে আসছে। এখন ঘনঘন সাইক্লোন হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে, আর হচ্ছে দাবানল।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণে ভূমিকা রাখে সবচেয়ে কম, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে। আর বছর তিরিশেকের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রের নিচে চলে যাবে। আমরা যে ভুগছি, তা সিডর-আইলার ধ্বংসচিহ্ন দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াও তো ভুগছে। ইউরোপে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল। কত বাড়িঘর ভেসে গেল। কত মানুষ মারা গেল। বন্যা হচ্ছে চীনে। দাবানল হচ্ছে গ্রিসে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়। মানুষ মারা যাচ্ছে, বন্য প্রাণী মারা যাচ্ছে, অগণিত মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন দূর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, বর্তমানের বাস্তবতা এবং অগণিত মানুষের এই মুহূর্তের দুর্ভোগের কারণ। এই বছর গরমে কানাডা-আমেরিকার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ভাবা যায়!

ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন জো বাইডেন। জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে তাঁরা কর্তব্যের ব্যাপারে সচেতন, সক্রিয় এবং অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে এ ব্যাপারে আমাদের সবারই করণীয় আছে; নিজের ঘরের বাতিটা অকারণে না জ্বালানো, কথায় কথায় গাড়ি না চালানো, গাছ না কাটা বা গাছ লাগানোর মতো কাজগুলো আমরা প্রত্যেকেই করতে পারি। সরকারি বড় প্রকল্পগুলোকে সবুজ করে তুলতে হবে। কয়লা, তেলের কারখানা থেকে সরে আসতে হবে। বনসম্পদ রক্ষা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই বৃক্ষরোপণ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন:

‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়—তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই।’

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক