বহুপাক্ষিকতা পথ থেকে সরে আসা?
যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত প্রায় তা-ই হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১১তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে। বিধিভিত্তিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্যব্যবস্থা জোরদার করার দীর্ঘদিনের প্রয়াসকে অনেকটা পাশে ঠেলে কয়েক পাক্ষিক বাণিজ্য সমঝোতার পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। গত বছরের ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিওর সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এই বৈঠকে সদস্যদেশগুলো কার্যত তাদের মতভেদ ধরে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
অথচ ১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে ডব্লিউটিওর মূল লক্ষ্য ছিল সমঝোতার মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য যথাসম্ভব ভারসাম্যমূলক বিধিবিধান তৈরি করা। ভাবা হয়েছিল, এই বিধিবিধান বহুপাক্ষিক (মাল্টিলেটারাল) উদার বাণিজ্যব্যবস্থাকে ক্রমেই প্রসারিত করবে এবং বাণিজ্য বিস্তারের পথে অন্তরায় হয়ে থাকা শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমিয়ে আনবে। এ জন্য ২০০১ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় চতুর্থ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে সদস্যদেশগুলো দোহা উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা (ডিডিএ) গ্রহণ করে। তারা একমত হয়েছিল যে এই কর্মসূচির আওতায় কৃষি বাণিজ্যে ভর্তুকি এবং শিল্পপণ্যে আমদানি শুল্কহার কমানোসহ বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী বৈশ্বিক বাণিজ্যবিধান তৈরি করা হবে। বাস্তবে দেখা গেল, এই সমঝোতা বা দর-কষাকষি (যা দোহা পর্ব নামে পরিচিত) ক্রমেই জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে দুই বছর অন্তর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হলেও সদস্যদেশগুলোর নানামুখী ও বিপরীতধর্মী বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং তাতে ছাড় না দিতে অনীহা তাদের ডব্লিউটিওর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়ার পথে বাধা তৈরি করে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন বিষয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করায় মতভেদ বহাল থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের পাশাপাশি বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি এবং ধরনেও কিছু পরিবর্তন চলে আসে; আসে নতুন নতুন বিষয় ও জটিলতা। এই বাস্তবতায় বিভিন্ন দেশ, বিশেষত উন্নত দেশগুলো প্রলম্বিত ও অসমাপ্ত দোহা পর্বের আলোচনা টেনে নিতে আর আগ্রহী হলো না।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বুয়েনস এইরেসে যখন আবার ডব্লিউটিওর ১৬৪টি সদস্যদেশ মিলিত হলো, তখন কিন্তু এই মতভেদটাই নতুনভাবে ফুটে উঠল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববাণিজ্যকে অবাধ থেকে সংরক্ষিত এবং বহুপাক্ষিক থেকে দ্বিপাক্ষিক করার নীতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার ডব্লিউটিওর আওতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিভিন্ন সময়ে অন্য দেশের কাছে হেরে যাওয়ায় এই সংস্থার ওপর তাদের ক্ষোভও গোপন নেই। তাই বুয়েনস এইরেসে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই কোনো রকম ছাড় না দেওয়ার কথা জানিয়ে দেয়।
ফলে এই সম্মেলনে খাদ্যনিরাপত্তাজনিত ভর্তুকিকে বাণিজ্য বিরোধের বাইরে রাখা কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধভাবে মাছ ধরার ব্যবসা আটকানোর বিষয়ে সমঝোতা হয়নি। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর শতভাগ বাজারসুবিধা নিয়ে কথা হয়নি। বরং বিভিন্ন উন্নত ও কিছু উন্নয়নশীল দেশ মিলে তিনটি নতুন বিষয়ে কয়েক পাক্ষিক (প্লুরিলেটারাল) বাণিজ্য আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। ৭১টি সদস্যদেশ ইলেকট্রনিক কমার্স (ই-কমার্স), ৭০টি সদস্য বিদেশি বিনিয়োগ সহজীকরণ (ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন) এবং সদস্যদেশ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এমএসএমই) বিষয়ে বৈশ্বিক বিধিবিধান প্রণয়নের জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ অবশ্য এর কোনোটিতেই নিজেকে যুক্ত করেনি। আপাতত তা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করা যায়।
তবে দুই বছর ধরে এ বিষয়গুলোর বৈশ্বিক বাণিজ্য বিধান প্রণয়নে ডব্লিউটিওতে আলোচনা শুরু করার কথা বলে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ ধনী দেশগুলো। কিছু উন্নয়নশীল দেশও এর পক্ষে সমর্থন দেয়। কিন্তু ভারতসহ বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ এতে আপত্তি জানায়। যেহেতু ডব্লিউটিওতে প্রতিটি সদস্যের সমান ভোটাধিকার এবং যেকোনো সদস্য ভেটো দিয়ে যেকোনো আলোচনা আটকে দিতে পারে, সেহেতু ১১তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এই নতুন বিষয়গুলো জায়গা পেল না। তবে ডব্লিউটিওর প্রায় অর্ধেক সদস্যই কোনো না কোনোভাবে এ বিষয়গুলোতে আগ্রহী হওয়ায় কয়েক পাক্ষিক আলোচনার দ্বার খুলে গেল। আর এই বিষয়গুলো ডব্লিউটিওর পরবর্তী কর্মসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার মানে ডব্লিউটিও এই কয়েক পাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনাকে সমর্থন করছে, ডব্লিউটিওর বিধানে এ ধরনের আলোচনা করতে বাধাও নেই। ১৯৪৭ সালে সূচিত জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) থেকে যখন ১৯৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ডব্লিউটিওর যাত্রা শুরু হয়, বহুপাক্ষিক চুক্তিগুলোর পাশাপাশি চারটি বিষয়ে কয়েক পাক্ষিক চুক্তি ছিল। এগুলো হলো বেসামরিক বিমান, সরকারি ক্রয়, ডেইরি বাণিজ্য ও মাংস বাণিজ্য। এর মধ্যে শেষ দুটির মেয়াদ ১৯৯৭ সালে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে আর সরকারি ক্রয় চুক্তিটি ২০১৪ সালে সংশোধন করা হয়েছে। একই বছর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও চীন পরিবেশবিষয়ক পণ্যে কয়েক পাক্ষিক আলোচনা শুরু করেছে। আবার ২০১৫ সালে নাইরোবি সম্মেলনে ৫৪টি সদস্যদেশ তথ্যপ্রযুক্তি চুক্তি কার্যকর করার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে।
তবে মনে রাখা দরকার, কয়েক পাক্ষিক বাণিজ্য সমঝোতা থেকে চুক্তি হলে তা প্রাথমিকভাবে শুধু সমঝোতাকারী দেশগুলোর জন্যই প্রযোজ্য। এতে চুক্তির বাইরে থাকা দেশগুলো স্বাভাবিকভাবেই সুবিধা পায় না। পরবর্তী সময়ে কোনো দেশ এতে শামিল হতে চাইলে তাকে বিদ্যমান চুক্তিই মেনে নিতে হয়। মুশকিল হতে পারে যদি এই কয়েক পাক্ষিক চুক্তি একপর্যায়ে বহুপাক্ষিক হয়ে ওঠে তখন। কেননা, যারা এই সমঝোতা বা দর-কষাকষিতে ছিল না, তাদের এখানে আর কথা বলার সুযোগই থাকে না। এতে তারা বৈষম্যের শিকার হয়।
সর্বোপরি আগামী দিনগুলোয় কয়েক পাক্ষিক আলোচনা অর্থবহভাবে অগ্রসর হলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে ডব্লিউটিওর সব সদস্যদেশের ওপর। এমন আশঙ্কাও রয়েছে যে কয়েক পাক্ষিক চুক্তিই পরবর্তীকালে বহুপাক্ষিক চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সবার জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যারা মূল আলোচনায় থাকেনি বা থাকতে পারেনি, তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপস করতে বাধ্য হবে। আর কয়েক পাক্ষিক আলোচনায় উন্নত বা শক্তিশালী দেশগুলো একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে। ফলে উন্নয়নশীল বা দুর্বল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর সেখানে খুব ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অথচ ডব্লিউটিওর বহুপাক্ষিক আলোচনায় গরিব বা ছোট দেশও নিজেদের কথা অনেকটা জোরের সঙ্গে বলতে পারে।
বাংলাদেশ যেহেতু আগামী ছয় বছরের মধ্যে এলডিসির তালিকা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে, সেহেতু চ্যালেঞ্জটা বাড়তি। কোনো কয়েক পাক্ষিক সমঝোতায় যুক্ত না থাকলে এলডিসির ছাড় ও এলডিসি-উত্তরণ পরবর্তী পর্যায়ে সমন্বয়ের সুবিধা দাবি করার সুযোগ থাকবে না। আবার এ ধরনের উদ্যোগে যুক্ত হতে গেলে দর-কষাকষিতে যে বাড়তি সক্ষমতা প্রয়োজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের রয়ে গেছে। আর তাই কয়েক পাক্ষিক বাণিজ্য সমঝোতাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে সম্ভাব্য কৌশল ও করণীয় নির্ধারণে অনতিবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
আরও পড়ুন
-
নাইজারে মার্কিন বাহিনীর অবস্থান থাকা ঘাঁটিতে রুশ সেনাদের প্রবেশ
-
সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন
-
উপজেলা চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে বদির গুলি, থানায় অভিযোগ
-
মিয়ানমারের পুরুষদের বিদেশে কাজে আবেদনও করতে দিচ্ছে না জান্তা
-
আমেথি থেকে সরে শেষ মুহূর্তে কেন রায়বেরেলি থেকে প্রার্থী হচ্ছেন রাহুল