Thank you for trying Sticky AMP!!

বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়াই শেষ কথা না

‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয় খুব সম্ভবত বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর। তবে প্রশ্নটি বোধ হয় শিশুদের জন্য মোটেই কঠিন কিছু নয়। কারণ শিশুদের জগৎ খুব সহজ-সরল। শিশুরা তাদের নিজেদের পরিসরেই স্বপ্ন কুড়িয়ে নিতে ভালোবাসে। ডাক্তার, শিক্ষক, খেলোয়াড়, পাইলট, গায়ক, নায়ক, ফায়ার ফাইটার, দোকানদার এ রকম কত কী হতে চায় তারা! আজকাল শিশুদের বলতে শুনি গেইমার কিংবা ইউটিউবার হওয়ার কথা। কিন্তু শিশুদের সহজ-সরল এই স্বপ্নগুলোর ওপর আমরা বড়রা আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে প্রত্যাশার প্রলেপ লাগাই। আর এই প্রক্রিয়ায় অনেক শিশুই জানতে পারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কিংবা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার এক সোনালি স্বপ্নের নাম। বুঝে না–বুঝেই শিশুরা চাপিয়ে দেওয়া জীবনের নতুন স্বপ্ন মুখস্থ করতে শেখে। পরবর্তী সময়ে তারা যতই বড় হতে থাকে, পরিবার, সমাজ আর বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের বোঝাতে থাকে সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা আর নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে বিসিএস নামক এক অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

আমার জীবনেও ঠিক একইভাবে রচিত হয়েছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন। আনার্স পরীক্ষা দিয়ে তাই অংশ নিই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায়। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের অগ্নিযুদ্ধ পেরিয়ে অবশেষে চূড়ান্তভাবে বিসিএসের স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলি। যোগ দিই প্রশাসন ক্যাডারে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে যোজন দূরত্বের বিষয়টি অনুধাবন করে অবসান ঘটাই সরকারি চাকরি জীবনের। চাকরি চালিয়ে যাওয়া কিংবা ছেড়ে দেওয়া প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু চাকরি ছাড়ার পর এক যুগ পেরিয়ে গেলেও হাজারো প্রশ্ন আজও আমার পিছু ছাড়ে না। সরকারি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্তটি এতটাই অস্বাভাবিক অনেকের কাছে! যেকোনো চাকরির ইন্টারভিউয়ে আজও আমার সরকারি চাকরি ছাড়ার প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে ভোলেন না চাকরিদাতারা।

আমার চাকরি ছাড়ার দুঃখ যেন তাঁদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। যেন কী এক সোনার হরিণ হাতে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছি আমি। কয়েকটি পত্রিকা পর্যন্ত এ নিয়ে আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই আমি বলার চেষ্টা করেছি, বিসিএস ছাড়াও পেশাগত জীবন হতে পারে বৈচিত্র্যময়, অর্থপূর্ণ। কিন্তু এর জন্য প্রযোজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং জীবনকে অন্যভাবে অনুভব করতে পারার ক্ষমতা। প্রশ্ন হলো, বিসিএসের প্রতি কেন আমাদের এই মোহ! বিসিএস ছাড়া পেশাগত জীবন কী একেবারেই ব্যর্থ? বিসিএসকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে আমরা নিজেরাই কি অতৃপ্তি বাড়িয়ে নিজেদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছি না?

কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল। কয়েক বছর ধরেই লক্ষ করছি বিসিএসে মেধাতালিকায় স্থানপ্রাপ্তদের নিয়ে অতিরিক্ত উন্মাদনা। এই বছর তা যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদগুলোর শিরোনাম এতটাই চটকদার আর সস্তা ছিল যে তা উত্তীর্ণদের গৌরবান্বিত না করে উল্টো হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে। যেমন পাঠক জানতে পেরেছেন বছরের পর বছর মোবাইল ফোনের ব্যবহার থেকে বিরত থেকে বিসিএসে সফল হওয়া প্রার্থীর নাম। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, বিসিএসে উত্তীর্ণ হতে দুর্দান্ত মেধার অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন নেই আর বিসিএস পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ের তেমন কোনো সুযোগও নেই। এটি মূলত মুখস্থ জ্ঞাননির্ভর একটি পদ্ধতি, যে পদ্ধতির মাধ্যমে মূলত দেখা হয় চাকরি পাওয়ার জন্য একজন প্রার্থী কতটা নিবেদিতপ্রাণ। যেহেতু পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন যেকোনো বিষয়ে পড়া ছাত্রছাত্রী এবং যখন প্রতিবছর প্রায় চার-পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে যখন দুই-আড়াই হাজার প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করতে হয়, তখন একটি পদ্ধতি অবলম্বন তো করতেই হয়।

তবে বিসিএস চাকরি নিয়ে সাধারণ মানুষের এই পাগলামি নিশ্চিতভাবেই কিছু বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম স্পষ্টভাবেই বলেছেন, দুর্নীতির ব্যাপকতাই বিসিএসের প্রতি মোহ তৈরি করছে। সরকারি চাকরিতে দুর্নীতির বাস্তবতাটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরিতে যে ত্যাগী, সৎ আর নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা নেই, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। আবার দুর্নীতি যে শুধু সরকারি চাকরিতেই আছে, তা–ও নয়। কিন্তু সরকারি চাকরিতে প্রায়ই গুরু অপরাধে লঘু শাস্তি কিংবা চাকরি না হারানোর বাস্তবতা দুর্নীতিকে যেন ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে। জনগণের সেবক না হয়ে কর্মকর্তারা যখন প্রভুর আসনে আসীন হন এবং নির্লজ্জভাবে ক্ষমতার প্রদর্শনে মত্ত হয়ে ওঠেন, তখন সাধারণদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তখন ভুক্তভোগীরা হয় ক্ষমতাধরদের দুর্নীতির সঙ্গে আপস করেন, নতুবা নিজেই ক্ষমতার উৎসে পরিণত হয়ে উঠতে চেষ্টা করেন। ক্ষমতাই যখন সামাজিক নিরাপত্তা, প্রতিপত্তি আর নিশ্চিত ভবিষ্যতের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়, তখন যুবসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিসিএস নামক ক্ষমতায়িত হওয়ার এই যুদ্ধে। যিনি আজীবন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সে জন্য পরিশ্রম করেছেন, তিনিও আজ প্রশাসন কিংবা পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ!

প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধ কতখানি স্বাস্থ্যকর! যুদ্ধ জয় করার এই নেশায় তরুণেরা তাঁদের জীবনের বর্ণিল সম্ভাবনাগুলোকে সংকীর্ণ করে ফেলছেন! এই মোহ যেন ক্রমেই গ্রাস করছে তরুণ সমাজকে। বিসিএস ক্যাডারভিত্তিক চাকরির মোহে অনেক তরুণ প্রতিভাকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। মনে রাখতে হবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো চাকরি নয়। ব্যক্তির জন্য এটিও আর দশটা পেশার মতোই অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার একটি পেশা। সবার জন্য পেশাগত জীবনে সাফল্যের চরম মানদণ্ড বিসিএস হতে পারে না।

বিসিএস নামক এক কেন্দ্রে আবর্তিত উচ্চাশার চক্রে ধরা দিচ্ছে সবাই। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে আছে হতাশা। আবার এই চাকরির সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পারলেও আছে হতাশা। কারণ, এই চাকরি ছাড়ার সামাজিক চাপ নেওয়ার সাহস বা ক্ষমতা সবার থাকে না। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসকে অতিরিক্ত গ্ল্যামারের মোড়কে উপস্থাপন করার এই প্রবণতা শুভ নয়। প্রতিটি কাজই সম্মানের আর মর্যাদার, যদি সেই কাজকে ভালোবাসা যায় আর তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায়। তাই শুধু বিসিএসকে গৌরবান্বিত করার মাধ্যমে জীবনের অন্য সম্ভাবনার পথগুলো যেন আমরা রুদ্ধ করে না ফেলি। নিজেদের ওপর আস্থা রাখি, আস্থা রাখতে শিখি প্রতিটি সম্ভাবনার ওপর।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক

purba_du@yahoo.com