ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতি উত্তরাঞ্চলের রাজনীতির চেয়ে কোনোভাবে ভিন্ন নয়। উভয় জায়গাতেই ব্যক্তিপূজার প্রথা প্রচলিত আছে। মানুষ পছন্দের নেতাদের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এমনকি সেটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তারা উন্মত্ত হয়ে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সরকার এটা নিষিদ্ধ করলেও থামাতে পারেনি।
তামিলনাড়ুর শশীকলা তেমনই এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন, যিনি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আজ তিনি এআইএডিএমকের সাধারণ সম্পাদক। ওদিকে দল তাঁকে আইন প্রণয়নকারী শাখার নেতা নির্বাচিত করেছে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী পনিরসেলভামকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। যেখানে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেখানে তিনি উপস্থিতও ছিলেন না।
কিন্তু তামিলনাড়ুর সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে সবার মধ্যেই উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। পনিরসেলভামও প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার আস্থাভাজন ছিলেন, তিনিও শশীকলার বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, শশীকলা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কিছুদিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কারণ, গভর্নর দৃশ্যত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অঙ্গুলিহেলনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এতে নাক গলিয়েছেন।
এমনকি অন্যদিক থেকে দেখলেও বলা যায়, শশীকলা ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক জয়ললিতার বিরুদ্ধে চলমান মামলার রায় এখনো না হওয়ায় লোক পরিবর্তনের সুবর্ণ সময় এখনো আসেনি। সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এক সপ্তাহের মধ্যেই রায় দেওয়া হবে। শশীকলা জিতুন বা হারুন, তাঁর অবস্থান কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষয় হতে শুরু করেছে।
শশীকলা তো সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন। জয়ললিতার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তিনি প্রভূত ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু জয়ললিতা কখনোই তাঁকে উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করেননি। কথা হচ্ছে, শশীকলার খ্যাতির কারণ হচ্ছে জয়ললিতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। এমন ব্যাপারও ঘটেছে যে জয়ললিতা শশীকলার ওপর বিরক্ত হয়ে তাঁকে কাছে ঘেঁষতে দেননি।
বিবেচনা করা হতো, শশীকলা মানারগুদি মাফিয়ার অংশীদার, তিনি মানুষকে বিরক্ত করতেন, যা কখনো কখনো জয়ললিতার লজ্জার কারণ হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে, শশীকলার সব কাজের পেছনে আছেন তাঁর স্বামী এম নটরাজন, আর শেষমেশ শুধু জয়ললিতাই নয়, শশীকলাও তাঁকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আর এটা তো উন্মুক্ত রহস্যই যে রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে শশীকলা বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, আর বিশেষ আদালত জয়ললিতাসহ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন।
জয়ললিতা যখন কারাগারে ছিলেন বা মামলা চলাকালীন পালিয়ে ছিলেন, তখন তিনি পনিরসেলভামের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, যাঁকে তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের গদিতে বসিয়েছিলেন। দলের একজন অনুগত কর্মী হিসেবে তিন গদিটা উষ্ণ রেখেছিলেন, আর যখন জয়ললিতার আসার সময় হয়েছে, তখন তিনি গদি ছেড়ে দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, পনিরসেলভাম জয়ললিতাকে এতটাই ভক্তি করতেন যে তিনি কখনো জয়ললিতার ব্যবহৃত চেয়ারে বসেননি, বরং তিনি অন্য একটি চেয়ার আনিয়ে তাতে বসেছেন। তাঁর চেম্বারে তো জয়ললিতার ছবি থাকতই, তার সঙ্গে তিনি পকেটেও জয়ললিতার ছবি রাখতেন। জয়ললিতার প্রতি এভাবেই তিনি অন্ধ আনুগত্য দেখিয়েছেন। তিনি এতটাই নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন যে জয়ললিতা যতবারই সমস্যায় পড়েছেন, প্রতিবারই তাঁকে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছেন।
প্রকৃত অর্থে জয়ললিতা এত উচ্চ আসনে ছিলেন যে কেউ তাঁর আশপাশে আসতে পারেনি। অনেকটা জওহরলাল নেহরুর মতোই, যিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো, যাঁর ছায়াতলে অন্য কেউ বেড়ে উঠতে পারেননি। ডিএমকের মতো শক্তিশালী দলের বাধা সত্ত্বেও তিনি এককভাবে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন, যে দলের নেতা হচ্ছেন এম করুণানিধির মতো একজন পিতৃতান্ত্রিক মানুষ।
কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির তামিলনাড়ুতে খুব কম অনুসারীই আছে। কারণ, বিজেপি মূলত উত্তরের দল হিসেবেই পরিচিত। শেষ লোকসভা নির্বাচনে এআইএডিএমকে যেখানে তামিলনাড়ুতে ৩৭টি আসন পেয়েছিল, সেখানে বিজেপি পেয়েছিল একটি আসন। তামিলনাড়ুতে এখন যে হাঙ্গামা চলছে, তাতে বিজেপি সেখানে ঢোকার আদর্শ সুযোগ পেয়ে গেছে। কিন্তু লোকসভায় কোনো বিল বা প্রস্তাব পাস করাতে এই ৩৭ জন সদস্য তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মনে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সবকিছু খুব কঠোর নজরদারি করছেন। সম্ভবত শশীকলার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলে কোনো একভাবে সন্দেহের অবসান হবে। এ ছাড়া তারা রাষ্ট্রে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চাইবে। ওদিকে শশীকলার স্বামী নটরাজনের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের ঘনিষ্ঠতা আছে, সে কারণে হয়তো বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পরিস্থিতি আমলে নিতে আগ্রহী হয়েছেন। শোনা যায়, অমিত শাহ পনিরসেলভামের পক্ষে আছেন। বিজেপি এই ব্যক্তির কাঁধে উঠে তামিলনাড়ুতে ভবিষ্যৎ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়।
শশীকলার বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তাতে পনিরসেলভামের সুবিধা হয়েছে। অভিযোগ আছে, এই শশীকলা অসুস্থতার সময় জয়ললিতার ভাগনিকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেননি। তিনি এক দল গঠন করে হুমকি দিয়েছেন, শিগগিরই তিনি অনেক গোপন ব্যাপার ফাঁস করে দেবেন। কিন্তু মানুষ এসব পছন্দ করছে না।
উত্তরের রাজনীতিতেও এসব নতুন ব্যাপার নয়। নেহরু চেয়েছিলেন, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী যেন তাঁর উত্তরসূরি হন। কিন্তু তখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে তাঁকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছিল না। সে কারণে তখনকার কংগ্রেস সভাপতি কে কামারাজ ঘোষণা করেন, প্রথমত শাস্ত্রী, তারপর ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু মোরারজি দেশাই কখনোই এই বন্দোবস্ত গ্রহণ করেননি।
এরপর ইন্দিরা গান্ধী দেশাইকে গ্রহণ না করে দল ভেঙে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেন। এমনকি কামারাজ যখন ইন্দিরাকে নেতা বানালেন, তখন তিনি তাঁকেও সরিয়ে দেন। ইন্দিরা একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি হলেন। একইভাবে এআইএডিএমকের মধ্যেও একই ভাঙন আসন্ন হয়ে উঠেছে, যদিও ব্যাপারটা একদম বানানো। দলটির আইনসভার সদস্যরা সবাই চান, শশীকলা যেন একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও দলীয় সাধারণ সম্পাদক হন।
এই পুরো নাটকটা কীভাবে মঞ্চায়িত হবে, তা এখনো বলা মুশকিল। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট, তা হলো, শশীকলা এক বড় শক্তিই বটে, যাঁকে গণ্য করতে হবে। পনিরসেলভামের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু তাঁর ভাগ্য ভালো, মানুষ তাঁর পেছনে আছে। এই ক্রান্তিকালে অন্তত এটাই মনে হচ্ছে। শশীকলার ভাগ্য নির্ভর করছে আদালতের রায়ের ওপর। তবে তিনি জয়ললিতা নন, ডিএমকেও বেশি দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।