ছাত্র আন্দোলন

ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শুনুন

খুদে শিক্ষার্থীরা এই নতুন স্বাভাবিককে মেনে নেয়নি। তারা রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু কোনো অরাজকতা করেনি
খুদে শিক্ষার্থীরা এই নতুন স্বাভাবিককে মেনে নেয়নি। তারা রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু কোনো অরাজকতা করেনি

প্রথম আলোয় একটি ছবি দেখে থমকে যেতে হলো। একটি কাগজে মার্কার কলমে লেখা, ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে’ এবং সেটি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন...। না, কোনো মাঠ গরম করা রাজনীতিবিদ নন, কোনো আদর্শবাদী বিপ্লবী নন, কোনো বুদ্ধিজীবী, এমনকি শিক্ষকও নন। কাগজটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোর, সে পথে নেমেছে শুধু রাজপথ, গলিপথকে নিরাপদ করতে নয়, ভবিষ্যতের পথটিকেও কণ্টকমুক্ত করতে। কিশোরটি ভবিষ্যতের যাত্রী, তার হাত ধরে বাংলাদেশও যাবে ভবিষ্যতে। সে পথে নেমেছে বাংলাদেশের জন্যও। তার মতো কয়েক লাখ শিক্ষার্থীও নেমেছে। তারা যে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে চায়, তাতে বিবেক যে বড় একটি উপস্থিতি হয়ে দাঁড়াবে, ওই কাগজের লেখাগুলো তারই আভাস দেয়।

স্কুল-কলেজের এই শিক্ষার্থীরা একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিল এই কদিনে। তাদের পথে নামার শুরুর কারণটি ছিল এক বীভৎস, হৃদয়হীন হত্যাকাণ্ড। সারা দেশে শহরে-মহাসড়কে প্রতিদিন এই হত্যাকাণ্ড চলে। মিডিয়া শোরগোল তোলে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিলটি শুধু লম্বাই হতে থাকে। এর কারণ আমাদের বিবেকহীন কিছু মানুষ, প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতি। দশকের পর দশক ধরে পরিবহন খাতে চলছে নৈরাজ্য। যে খাতটি সরকার চালাতে পারত, সরকারেরই চালানোর কথা ছিল, তা ছেড়ে দেওয়া হলো বেসরকারি পরিবহন খাতে, বিবেকহীন, মুনাফালোভী পরিবহন ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের পিঠে অভয়ের হাত রাখলেন রাজনীতিবিদেরা, তারা সুরক্ষা পেল পুলিশ ও প্রশাসনের।

এরা একটা সাম্রাজ্যই গড়ে তুলল ধীরে ধীরে। তাদের ভিতটা আগলে রাখার জন্য তারা কাজে লাগাল শ্রমিকদের। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে। এরা এত শক্তিশালী হয়ে উঠল যে, যত বেপরোয়া হোক চালকেরা, যত ইচ্ছাকৃত হোক কোনো দুর্ঘটনা, অপরাধী কাউকে আইনের হাতে তুলে দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ল। বর্তমান সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী এই সংগঠনগুলোর বড় নেতা। দোষী এবং দোষীর বিচারের মাঝখানে যদি দেয়াল হয়ে শক্তিশালী কেউ দাঁড়িয়ে যান, বিচারের বাণী তখন চুপচাপ আড়ালে বসে শুধু চোখের পানি ফেলে।

আমরা বয়স্করা এসব অনাচারে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে প্রতিবাদ করার ইচ্ছাটাও আমাদের আর নেই। আমাদের অনেকে আবার নানা হিসাব কষে জীবনে চলি, নানা মানুষ আর প্রতিষ্ঠানকে সমঝে চলি। দুর্নীতিতে দেশটি ছেয়ে গেছে, ক্ষমতা-পদ-প্রশংসা-বস্তুলোভী মানুষের সংখ্যা এমন বেড়েছে যে তাদের একটা তালিকা করতে গেলে আদমশুমারির কর্মীদেরও ঘাম ঝরাতে হবে। ফলে কোনো প্রতিরোধ হয় না।

আমরা প্রতিবাদ করি না বলে অরাজকতা, অস্বাভাবিকতাগুলো ‘নতুন স্বাভাবিক’ বা ‘নিউ নর্মাল’ হয়ে গেছে। সড়কে মৃত্যু এখন নতুন স্বাভাবিক, কোনো দাবি নিয়ে রাজপথে না দাঁড়াতে পারাটা এখন নতুন স্বাভাবিক, পুলিশের বাড়াবাড়ি, গুম-খুন, পুলিশের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব সরকারি ছাত্রসংগঠনগুলোর নিয়ে নেওয়াটা, এমনকি ‘সরকারবিরোধী’ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়াটাও এখন নতুন স্বাভাবিক। অনেক বেদনার ভারে পথে নামা খুদে শিক্ষার্থীদের পুলিশ যে পেটাল তা-ও ওই নতুন স্বাভাবিকের অংশ। গাড়ির চালকের লাইসেন্স নেই, বাসের রুট পারমিট নেই, ১৩ বছরের চালকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে লেগুনা-হিউম্যান হলার-এসবও সেই নতুন স্বাভাবিক। বছর বছর বাড়তে থাকা নতুন স্বাভাবিকের বিষগাছটি এখন ঝেঁপে ফল দিচ্ছে। তাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বিবর্ণ হয়ে গেছে।

খুদে শিক্ষার্থীরা এই নতুন স্বাভাবিককে মেনে নেয়নি। তারা রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু কোনো অরাজকতা করেনি। তারা যেসব বাস ভেঙেছে, সেগুলো রাস্তায় নামানোই তো ছিল একটা অপরাধ। তারা অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি গাড়িকে অবাধে চলতে দিয়েছে। ঝাড়ু দিয়ে ভাঙা কাচ সরিয়েছে। মানুষের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করেছে। তারা গাড়ি থামিয়ে চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে। এটি তো পুলিশের করার কথা, নাকি? কিন্তু নতুন স্বাভাবিকে পুলিশ এসব দেখেও দেখে না। নতুন স্বাভাবিকে হাসতে হাসতে সবাই ব্যাংকে যায়।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তারা দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতাধর, বিবেকহীন মানুষদের সেবা দিয়ে যাওয়া এই আরোপিত, ‘স্বাভাবিক’কে মানবে না। তাদের কথা খুব পরিষ্কার, তাদের কথা এই কদিন সারা দেশ শুনেছে এবং আড়মোড়া ভেঙে জেগেছে। দেশ দেখেছে, এই শিশু-কিশোরেরা কোনো রাজনীতির ধার ধারে না, তারা ইতিহাসের ভালো পাঠগুলো নিচ্ছে (একুশের শহীদেরা তাদের অনুপ্রেরণা, শিক্ষার্থীরা তা-ই জানাল, শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করল), তারা ক্ষমতার রাজনীতি, বস্তুপ্রীতি আর দুর্নীতির স্পর্শ থেকে অনেক দূরে। যারা পাওয়ার দলে নেই, যারা সমাজকে শুধু দিয়েই যাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের ভেতর এই শিক্ষার্থীরা একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, যেটি খুব সাদামাটাভাবে বললে স্বাভাবিকতার প্রত্যাবর্তন; যে স্বাভাবিকে নিয়মনীতি আছে, সুনীতিচর্চা আছে, জবাবদিহি আর স্বচ্ছতা আছে, মানুষের প্রতি, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা আছে; আর সবচেয়ে বড় যা আছে তা হচ্ছে বিবেক।

আমি এই স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের পথে নামা, একটা বিরাট ধাক্কা দিয়ে সমাজকে জাগিয়ে দেওয়াটাকে বিপ্লব বলেছি। আমি জানি, বিপ্লব এখন একটি কঠিন স্বপ্ন, কঠিনতর একটি সম্ভাবনা। বিপ্লব অচলায়তন ভাঙে, সমাজের কাঠামোগুলো বদলে দেয়। এটি নিশ্চয় হয়নি-হবে যে, সেই সম্ভাবনাগুলোও কম। সরকার বলছে বটে, এদের কথা শুনবে, কিন্তু কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে, তা বলা মুশকিল।

সেই কথা অনুযায়ী যে কাজ হবে, সেটা ভাবারও তেমন কারণ নেই। কারণ, নতুন স্বাভাবিকের ঠিকাদারেরা নিশ্চয় বসে থাকবেন না। এর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার সব চেষ্টা তাঁরা করবেন। কারণ, এতে বিনিয়োগ ব্যাপক। বৃহস্পতিবার সব শিক্ষায়তন বন্ধ করে আন্দোলনের গতিটা কমানোর চেষ্টা হলো। এরপর হয়তো অন্য পথ দেখা হবে। আমার অভ্যস্ত চোখে যা ধরা পড়ছে: কিছুদিন বিচ্ছিন্নভাবে চলবে আন্দোলনটি। তারপর স্তিমিত হয়ে পড়বে। তারপর নতুন স্বাভাবিক তার নিজস্ব রূপে আর গতিতে ফিরবে।

কিন্তু আমি যে এই আন্দোলনটাকে বিপ্লব বললাম, তাতে একটা আশাবাদ আর সম্ভাবনার ছবি জেগে থাকে। আমরা ধরে নিই, সবকিছু এভাবেই চলবে, নষ্টরা সব ভোগ করবে। কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা একটা জোর আওয়াজে জানিয়ে দিল, তারা এসব মানবে না। এই আওয়াজটা আরও অনেকেই দিয়েছে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, এই বয়সের শিক্ষার্থীরা স্কুলে-কোচিং ক্লাসে কম্পিউটার গেম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় কাটায়।

আমি শহরের-গ্রামের অনেক স্কুল-কলেজে গিয়ে হতাশ হয়েছি। শিক্ষার্থীদের জন্য মাঠ নেই, গ্রন্থাগার নেই, আনন্দের কোনো খোরাক নেই। আছে শুধু পরীক্ষার টিউশনির নিপীড়ন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি সমাপনী নামে দুটি অকারণ পরীক্ষার বোঝা তাদের ওপর চাপানো হলো, টিউশন-নোটবই-বাণিজ্য পৌঁছে গেল গ্রামের তৃণমূলে। অনেককেই বলতে শুনেছি, এরা বইয়ের বাইরের জগৎটাকে চেনে না।

আমি আশাবাদী বলে এ কথাটা মানতে রাজি হইনি। আমি জানি, এদের যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়; এদের ভাষা-দক্ষতায়, গণিতে, বিজ্ঞানে দুর্বলতা আছে। মাদ্রাসার এক বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু এদের ভেতর সুন্দর আর সত্যের জন্য, ভালো কিছু করার জন্য যে তীব্র একটি আকাঙ্ক্ষা আছে, তা-ও আমি দেখেছি। প্রচলিত পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেও তারা যে নতুন স্বাভাবিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের চিন্তায় যা স্বাভাবিক তার প্রত্যাবর্তন চাচ্ছে, এটিই তো একটি বিপ্লব। একদিন যে এই চিন্তাটি সারা দেশের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে না, দেশটা বদলে দেওয়ার সংগ্রামে তারাও নামবে না, তা কে বলতে পারে?

দয়া করে তাদের কথা শুনুন। তারা বিবেকের পুনরাধিষ্ঠান চাইছে, সেটা নিয়েও ভাবুন। এরাই ভবিষ্যৎ; এদের কণ্ঠে—ভবিষ্যতের কণ্ঠটাই আমরা শুনতে পাচ্ছি। এই কণ্ঠকে সম্মান জানিয়ে সমাজের, রাজনীতির, প্রতিষ্ঠানের, বিবেকের ঘুণ-পোকাগুলোকে নির্মূল করুন। এই কণ্ঠকে পাশ কাটিয়ে গেলে যে ক্ষতিটা হবে, তা পোষানোর মতো শক্তি আমরা কোনো দিনই হয়তো পাব না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ