
আমাদের ছোটবেলায় ভাংতি পয়সারও অনেক দাম ছিল! আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম তখন চার আনা, আট আনা পেলেই খুব খুশি হতাম! আট আনার ভারী আধুলিটি পকেটে থাকলে তার অস্তিত্ব অনুভবে রাজা মনে হতো নিজেকে! স্কুলের বিরতি সময়ে কত কিছু যে কেনা যেত এই আধুলি দিয়ে! বাসায় আম্মার সিকি-আধুলির একটা মাটির ব্যাংক ছিল, যেখানে পয়সা জমিয়ে আম্মাকে অনেক সাংসারিক জিনিস কিনতে দেখেছি! তারপর টাকার মান কমতে কমতে একসময় পাঁচ টাকা, দশ টাকাও গুরুত্বহীন হয়ে গেল। আর সিকি–আধুলি রীতিমতো উধাও হলো আমাদের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন থেকে! বড় হতে হতে পকেটের ভারী পয়সা কোথায় যেন হারিয়ে-পালিয়ে গেল!
ইংল্যান্ডে প্রবাস জীবন শুরু না হলে আমি হয়তো জানতেও পারতাম না যে পৃথিবীতে এখনো সিকি-আধুলির চল আছে! লন্ডনে প্রায় এক যুগ বসবাসের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি, সেখানে ১ পেন্স, ২ পেন্স দিয়েও এখনো সক্রিয় লেনদেন হয়! সুপার স্টোরে বিল মিটিয়ে মানুষ রীতিমতো ১ পেন্স ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে! অবশ্য কারও অপেক্ষার স্নায়ুর চাপের আগেই তা ফেরত দেওয়া হয়! ১ পেন্স ফেরত পাওয়ার হলে বিনাবাক্যেই আপনি তা ফেরত পাবেন—এটাই সেখানকার স্বাভাবিক নিয়ম ও সংস্কৃতি! প্রতিটি সুপার স্টোরেই 'কয়েন কনভার্টার' আছে! মানুষ তাদের জমানো কয়েন নিয়ে আসে সেখানে, তা নোটে পরিণত করার জন্য! সামান্য কিছু ফি দিয়ে এই কাজ সম্পন্ন করা যায় মেশিনেই! কেউ আবার ভাংতি থেকে পাওয়া পুরো টাকাটা দিয়ে দেয় পছন্দের চ্যারিটিতে! লন্ডনে থাকাকালীন বাসায় আমার নিজেরও একটা ব্যাংক ছিল ভাংতি পেন্স জমানোর! বছরে বছরে একবার আমিও জমানো পেন্সকে পাউন্ডে রূপান্তরিত করেছি! মনে আছে একবার পশ্চিমা ধ্রুপদি সংগীতের সিডি কালেকশন কিনেছিলাম সেই পয়সা দিয়ে! এই তিল তিল পেন্স সঞ্চয় এবং তার পাউন্ডে রূপান্তর এবং তার সংগীতে পরিণত হওয়ার বিবর্তনের অনুভূতিটি নিশ্চিতভাবেই অসাধারণ ছিল আমার জন্য! আর আমার ভালো লাগত ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া সিকি-আধুলির অস্তিত্বের বিষয়টি প্রবাস জীবনে আবার সক্রিয় হয়ে ফেরত আসায়!
শুধু লেনদেনে কিন্তু নয়, পশ্চিমা জীবনে এই কয়েন সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়! এয়ারপোর্টে নেমে ট্রলি নেওয়া থেকে শুরু করে গাড়ি পার্কিং বা পাবলিক টেলিফোন-টয়লেট ব্যবহার করার জন্য এই কয়েন অনিবার্য! একবার ক্যাম্পিং করতে গিয়ে ২০ পেন্সের কয়েন লেগেছিল স্নান সারতে, কয়েন ঢোকানোর পর ৮ মিনিটের উষ্ণ জলের ধারা বের হয়ে এসেছিল শাওয়ার বেয়ে! পশ্চিমা জীবনে প্রায় প্রতিটি মানুষের ওয়ালেটে/পার্সে কয়েন রাখার একটা বিভাগ থাকে! সার্ভিস ভেদে সেখানে নানা জাতের কয়েন প্রয়োজন হয়!
ইংল্যান্ডের জীবন কয়েন চর্চায় ভালোই কাটছিল! কিছুটা মুশকিলে পড়লাম প্রবাসের পাট চুকিয়ে আবার দেশে আসার পর! দেখলাম মানুষের জীবন থেকে কয়েন প্রায় উধাও হয়ে গেছে! টাকার মান কমতে কমতে এবং দৈনন্দিন জীবনে কয়েনের অন্য কোনো ব্যবহার না থাকায় কয়েন আর এখন দেখাই যায় না! অথচ কয়েন কিন্তু দরকার, প্রয়োজন ছিল কিছু কিছু লেনদেনে! আমি আমার দৈনন্দিন জীবন থেকেই দুটি উদাহরণ দিচ্ছি! এক. আমি গ্রামীণফোনের ১০৯ টাকার প্রিপেইড প্যাকেজটি ব্যবহার করি! এ ক্ষেত্রে দোকানদার/এজেন্ট সব সময় ১১০ টাকা রাখতে চায়! ১ টাকা কখনোই ফেরত দিতে চান না! আমার ইন্টারনেট প্যাকেজটিও ১৪৯৯ টাকার! কিন্তু নগদ পরিশোধ করলে এরা ১৫০০ টাকা রাখে এবং কখনোই ১ টাকা ফেরত দিতে চায় না! আমি বিষয়টি ভুলতে বা মানতে পারি না এবং প্রতিবার (আমাকে কৃপণ ভাববে এটা বিবেচনার পরও) ১ টাকাও ফেরত পেতে চাই! এভাবে গ্রামীণফোনের এজেন্ট এবং ইন্টারনেট এজেন্ট থেকে আমি টাকা আদায় করেছি এবং সব সময় করতেই চেষ্টা করি! আমার দিকে এরা অবাক বিস্মিত তাকিয়ে থাকলেও আমি নির্বিকারভাবে বলি—ভাই, আমার ১ টাকা ফেরত দিন!
ভাবতে থাকি, এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারত! প্রথমটি হচ্ছে সরকারিভাবে কয়েন উঠিয়ে দেওয়া এবং বেসরকারি পর্যায়ে ১০৯ টাকা বা ১৪৯৯ টাকা জাতীয় রেট নির্ধারণের পশ্চিমা অনুকরণ বাদ দিয়ে সবকিছুর এমন একটা দাম নির্ধারণ করা, যাতে ১ টাকা বা কয়েনই আর ফেরত দিতে না হয়! এবং রাষ্ট্র-সরকারেরই আসলে উচিত এ বিষয়ে যথাযথ সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া! আর নইলে কয়েন রেখে দেওয়া এবং এর একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যবহার বা আদান-প্রদানও নিশ্চিত করা! কিন্তু এখন যা চলছে তা রীতিমতো অস্বস্তিকর এবং কিছুটা অন্যায়ও বটে! এই যে আমার প্রাপ্য ১ টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, এটা তো রীতিমতো অপরাধ! এবং আমরাও যে এই ফেরত না দেওয়া মেনে নিয়েছি, সেটাও কিন্তু এক সামাজিক অপরাধ! আর সমাজ-সরকার যে এই বিষয়গুলো শনাক্তই করতে পারে না এবং পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ তা তো সমাজ-রাষ্ট্রীয় অযোগ্যতার এক লজ্জা!
বুঝি আরেকটি বিষয়ও! যে সমাজে টাকার মূল্য কমতে কমতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে পথেঘটে ২-৫ টাকার নোট ধুলায় গড়ালেও কেউ তুলে নেয় না বা ভিখারির ভিক্ষাও ন্যূনতম ৫–১০ টাকার নোট, সেখানে কয়েন তো অসহায় হয়ে এ রকম নির্বাসিত হবেই! আমার কাছে কিন্তু আরেকটি বিষয়ও মনে হয়েছে! আসলে এই পুরো লেখাটির সূত্রপাত সেই বোধ থেকেই! সেটা হচ্ছে আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি-অন্যায়ের মাত্রা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি মানুষের নৈতিক বোধ এবং অনুভূতির, স্পর্শকাতরতার জায়গাটাও দিন দিন বোধহীন-ভোঁতা হয়ে পড়েছে অনেকটাই! গোটা জীবনটাই যেখানে বড় বড় অনিময়-অন্যায়-বোধহীনতার চাদরে মোড়ানো, সেখানে আর ১ টাকার কয়েন ফেরত দেওয়া বা ফেরত পাওয়ার ছোট্ট বিষয়টির জায়গা হয়? মানে আমরা সার্বিক অর্থেই টাকা এবং জীবনের মান এবং সূক্ষ্ম অনুভূতির জায়গাটা এমন কমিয়েছি যে নিজেদের অর্জিত টাকাগুলোকেও একটা অর্থহীন জায়গায় নিয়ে গেছি! ১ টাকা, ২ টাকা নিয়ে কথা বলাটাকেও একটা অপমানকর-উপহাসময়-অপ্রয়োজনীয় জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছি আমরা! উন্নত বিশ্ব যেখানে ১ পেন্স ২ পেন্সের সযত্ন-প্রয়োজনীয় ব্যবহার করছে, সেখানে আমাদের ২–৫ টাকার নোট তুলে নেওয়ার অযোগ্য হয়ে ধুলায় গড়াচ্ছে!
বলে রাখি, আমার কিন্তু এখনো মাটির একটা ব্যাংক আছে! এখনো আমার প্রাপ্য ১ টাকার কয়েন আমি দোকানদার/এজেন্ট থেকে ফেরত নিয়ে আসি! পাঁচ টাকার নোটের বদলি কয়েন জোগাড় করে টুপ করে মাটির ব্যাংকে ফেলি! কয়েনের ভারীত্ব সব সময়ই আমার ভালো লাগে! সমাজের নির্বাসিত-পলাতক কয়েনগুলো পরম যত্নে আমার ব্যাংকে কিছুটা হলেও ঠাঁই পেতে থাকে! পুরোনো জীবনকে আমি নতুন জীবনেও জাগরুক রাখি! আমার আম্মা কখনো আমাকে কিছু কয়েন দিয়ে যায় মাটির ব্যাংকটাতে রাখার জন্য, হয়তো তারও এক সময় যে সিকি-আধুলির একটা মাটির ব্যাংক থাকত—সেই কথাটা মনে থাকে! আমি আমার কয়েনগুলো জমিয়ে রাখি কোনো এক অনাগত কালের কিছু একটা প্রয়োজন মেটাব বলে! কয়েনের মতো জীবনের এই সব সামান্য-অনালোচিত বিষয় নিয়ে ভাবতে-ব্যাপ্ত থাকতেও দারুণ ভালো লাগে আমার...
মনজুরুল আজিম পলাশ: লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।