Thank you for trying Sticky AMP!!

ভিন্ন কোনো মতলবেই কি তালেবান ঠেকাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র?

আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে মার্কিন সৈন্যরা, দেশটিতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাতের অন্ধকারে চুপিসারে আফগানিস্তানের বাগরাম ঘাঁটি ছেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা। বাগরাম ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা হুট করেই চলে গেল। ছাড়ার আগে মার্কিনরা কিছুই জানায়নি। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে এর দায়িত্বও হস্তান্তর করেনি। এমনকি বাগরামে পাঁচ হাজার তালেবান বন্দী বিনা বাধায় চলে গেছে। কাবুলের নিরাপত্তার জন্য এ ঘাঁটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই ঘাঁটি স্থাপন করে আফগান যুদ্ধ পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের আঁধারে চলে যাওয়া বিস্ময়কর বটে। তুমুল ক্ষমতার অধিকারী মার্কিন সৈনিকদেরও গোপনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যেতে হয়। এমন ঘটনা কয়েক দিন আগে কেউ কল্পনাও করেনি। যদিও এটা নিতান্তই কৌশলগত বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে এ ঘটনা আফগান ও এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

মার্কিন সৈন্যরা একদিকে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে আফগান সরকারের সৈন্যরা তালেবানের সঙ্গে লড়াইয়ে কুলাতে না পেরে প্রতিবেশী তাজিকিস্তানে আশ্রয় নিচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছে। কার্যত আফগানিস্তানের বেশির ভাগ এলাকাই তালেবান নিয়ন্ত্রণ করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পরপরই কাবুল সরকারের পতন হতে পারে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা মনে করছে, ছয় মাস টিকে থাকবে আফগান সরকার। এ কারণে সব পক্ষই তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। সবাই ধরে নিয়েছে তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরছে। না ফিরলেও আফগান রাজনীতিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।

তালেবানের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে স্থানীয় জনসাধারণকে মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের আহ্বান জানিয়েছে আফগান সরকার। কিন্তু এতে খুব বেশি সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। বড়জোর হালকা প্রতিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি আঁচ করে আফগান সরকারও তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করছে। তেহরানে ইরান সরকারের মধ্যস্থতায় তালেবানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নিরাপদ নির্গমনের জন্য তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া আফগান সরকারের বিকল্প নেই। তালেবানের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহারের কথা রয়েছে। আল-জাজিরার তথ্যমতে, বর্তমানে আড়াই হাজার মার্কিন সৈনিক আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। যুদ্ধ চলাকালে সর্বোচ্চ এক লাখ ন্যাটোর সৈনিক আফগানিস্তানে ছিল। ইতিমধ্যেই জার্মানি ও ইতালি তাদের সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহার করেছে।

তালেবানের পুনরায় আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা ও শঙ্কার পদধ্বনির পরও মার্কিনরা মূলত দুটি কারণে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের কোনো বিজয় আনতে পারেনি। বরং এসব দেশে প্রতিপক্ষ চীন, রাশিয়া ও ইরানকে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ গুরুত্ব হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। এই অবস্থায় তালেবানের রাশিয়া, চীন ও ইরানের গোপন সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের পরাজয় ও বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই আফগান যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের আগেই মোটামুটি সাম্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চলে যাওয়া কৌশলগত দিক থেকে সুবিধাজনক। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের মতো আরেকটি পরিণতি মার্কিনদের গ্রহণ করা কঠিন হবে। তাই ইরাক থেকেও ইতিমধ্যে মার্কিন সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় এমন এক যুদ্ধ হয়েছে, যেখানে যুদ্ধরত দলগুলো কেউই হারেনি। সবাই নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করছে। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় রাজনীতির নির্মম এই খেলায় হেরেছে কেবল নিরীহ জনসাধারণ। প্রায় ২০ বছরের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় কমপক্ষে ১০ লাখ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে অর্ধকোটির বেশি।

আফগানিস্তানের কথাই ধরা যাক। এখানে তালেবান মনে করছে আফগান সরকারকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি তাদের জন্য বড় ধরনের বিজয় ও স্বীকৃতি। আবার যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করেছে। এটাও তাদের বিজয়। অন্যদিকে আফগান সরকার দাবি করছে তালেবানদের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে আফগান নাগরিকদের মুক্তি দিয়েছে। সব পক্ষের বিজয়ী অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আফগানিস্তান পরিত্যাগ করা মঙ্গলজনক। তাই বিভিন্ন পক্ষ গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা পরিবর্তনের কোনো আভাস এখনো পাওয়া যায়নি। বড়জোর হাজারখানেক সৈনিক কাবুলে থাকতে পারে আফগান সরকারকে পাহারা দেওয়ার জন্য। এটাও খুব বেশি টেকসই পরিকল্পনা হবে না। হতে পারে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের লিখিত চুক্তির বাইরেও গোপন সমঝোতা হয়েছে, যা প্রকাশ করা হয়নি। এ সমঝোতা অনুসারে আফগানিস্তানে মার্কিনরা তালেবানের কাবুল দখলের পথে বাধা সৃষ্টি করবে না। এটা হবে তালেবানের পুরোপুরি রাশিয়া, চীন ও ইরানের ওপর নির্ভরশীল হওয়া থেকে বিরত রাখার শেষ চেষ্টা। এতে করে তালেবানের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের অন্তত গোপন যোগাযোগ থাকবে এবং এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব একেবারেই বিলুপ্ত হবে না।

ইন্দো প্যাসিফিক জোট, কোয়াডসহ বিভিন্ন জোট তৈরি করে চীনের সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় রাশিয়া, চীন ও ইরানের সম্মিলিত শক্তিকে মোকাবিলা করার চেয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে এককভাবে মোকাবিলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ হবে।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির অগ্রাধিকার তালিকায় নতুন নতুন লক্ষ্যে যুক্ত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমল থেকেই এই পরিবর্তনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপ ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চাইছে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে মার্কিনদের চিন্তাভাবনা দ্রুতই স্পষ্ট হচ্ছে। ইন্দো প্যাসিফিক জোট, কোয়াডসহ বিভিন্ন জোট তৈরি করে চীনের সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় রাশিয়া, চীন ও ইরানের সম্মিলিত শক্তিকে মোকাবিলা করার চেয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে এককভাবে মোকাবিলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ হবে। আর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বন্দ্বে চীন ইরান ও রাশিয়াকে সহজে সম্পৃক্ত করতে পারবে না। আফগানিস্তান থেকে সিরিয়ায় তিন দেশ যেভাবে যৌথভাবে কাজ করছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে তা না-ও হতে পারে। বরং এই অঞ্চলে ভারতের সহযোগিতা পাবে যুক্তরাষ্ট্র।

সম্ভবত এসব হিসাব-নিকাশ করেই যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সহসাই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ সৃষ্টি হতে পারে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে মার্কিন নিরাপত্তা নীতির লক্ষ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ভরকেন্দ্র আফগানিস্তান ও আরব অঞ্চল থেকে সরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বাড়তে পারে। এসব দেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর যেকোনো গোষ্ঠীর তৎপরতা মার্কিনদের অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেবে।

সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছাড়াও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। ভারতে করোনা পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদির সরকার সামাল দিতে পারছে না। আমাদের দেশেও একই অবস্থা। মিয়ানমারে সামরিক সরকার কঠোরভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে দমন করছে। তাদের রোহিঙ্গা সংকট রয়েছে। থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে অনেক দিন ধরেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও ধর্মীয় কট্টরপন্থার নামে বিভিন্ন সংগঠনের নড়াচড়া অনেক আগে থেকেই আছে। সব মিলিয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল হতে পারে যুদ্ধ, সংঘাত, দ্বন্দ্বের এক নতুন উর্বর ভূমি।

তাই আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়া মানেই মার্কিনরা নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াবে না, এমন ভাবনার অবকাশ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ভিন্ন মহাদেশ হওয়ায় এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মতো পরস্পর যুক্ত না হওয়ায় উড়ে এসে আগ্রাসন করাই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ। ১৯৫২ সালে বার্লিন সংকট দিয়ে শুরু। এরপর কোরিয়া উপদ্বীপের যুদ্ধ, কিউবার মিসাইল সংকট, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ ও সবশেষে আফগান-আরব যুদ্ধ সব জায়গাতেই হয় সরাসরি বা গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছিল। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন ডকট্রিনের অন্যতম নীতি। আফগান যুদ্ধে যতি চিহ্ন দেওয়া অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র শান্তির পথে চলে এসেছে। আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এটা হতে পারে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল।

এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটছে বলে প্রচারণা শুরুও হয়েছে। মার্কিন নীতি প্রভাবিত গবেষক, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী ও থিঙ্কট্যাংকগুলো প্রাথমিক প্রচারের কাজটি করে দিচ্ছে। একইভাবে তারা ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রচার করেছিল। এই প্রচারে উদ্দেশ্য যদি হয় সতর্ক করা ও সন্ত্রাসবাদ রোধ করা, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীকে দিয়ে প্রচার-প্রচারণা সম্পন্ন করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র। আর অবশ্যই সংঘবদ্ধ প্রচারণার পাশাপাশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও সক্রিয় হয়ে হামলা, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে। এভাবেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক