Thank you for trying Sticky AMP!!

মানসিক চিকিৎসক–সংকট কাটাতে যা করা যায়

সম্প্রতি প্রথম আলো পত্রিকায় বাংলাদেশে মনোরোগ চিকিৎসার দুরবস্থা নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেনের একটি লেখা বেরিয়েছে। তাঁর লেখার ওপর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদের প্রতিক্রিয়া এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তৌহিদ হোসেনের মন্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। পেশাগত আগ্রহের কারণে তিনটি লেখাই আমি পড়েছি। কিছু তথ্য নিয়ে দ্বিমত সত্ত্বেও তিনটি লেখারই একটি অভিন্ন সুর স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ সমস্যার সমাধানে এ পর্যন্ত গৃহীত পরিকল্পনা পরিস্থিতির উন্নয়নে অপর্যাপ্ত।

১৯৯০ সালে এফসিপিএস পাস করে আমি যখন একজন নবীন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ছিল কমবেশি ৪০। ২০২০ সালে এসে সেই সংখ্যা হয় ২৭০–এর মতো। ৩১ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক। সেই তুলনায় বিশেষজ্ঞের সংখ্যা এখনো যা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।
২০১৮-১৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে সব ধরনের মানসিক রোগের হার (গুরুতর ও কম গুরুতর মানসিক রোগ) প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ১৮ শতাংশ এবং শিশু ও কিশোরদের মধ্যে ১৪ শতাংশ। বর্তমান জনসংখ্যার বিচারে তাই মোট রোগীর সংখ্যা যে বিশাল, এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই।

দেশে যে গতিতে নতুন বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছেন, তাতে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আমি একমত, এ সংখ্যায় বড় কোনো অগ্রগতি হবে না। বর্তমানে চার বছর মেয়াদি এফসিপিএস এবং এমডি কোর্স চালু আছে। যদিও আগের তুলনায় এখন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হতে আগ্রহী চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েছে, তবু সে সংখ্যা যথেষ্ট নয়। আমার মনে হয়, দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন না বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। এর পাশাপাশি যদি স্বল্পমেয়াদি দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু থাকত, তাহলে আমার বিশ্বাস, আরও বেশিসংখ্যক আগ্রহী চিকিৎসক পাওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর আরও ২৫–৩০ জন অতিরিক্ত বিশেষজ্ঞ তৈরি হতেন। ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকদের জেলা পর্যায়ে জুনিয়র কনসালট্যান্ট বা কনসালট্যান্ট পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হতো।

শুনেছি, সম্প্রতি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের উদ্যোগে দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-সাইকিয়াট্রি কোর্স চালু হতে যাচ্ছে। আমি এ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। এর পাশাপাশি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এমন মেডিকেল–কলেজ, যাদের দক্ষ জনবল আছে এবং সাইকিয়াট্রি আউটডোর ও ইনডোর–সুবিধা আছে, সেখানে দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-সাইকিয়াট্রি কোর্স চালু করা যেতে পারে। বিদ্যমান দুটি দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে আরও পাঁচ–ছয়টি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা সম্ভব হলে প্রতিবছর যুক্ত হওয়া বিশেষজ্ঞের সংখ্যা একটা যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত হবে এবং দেশব্যাপী মানসিক রোগসংক্রান্ত সেবা প্রদান অনেক সহজ হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আর্থিক সহায়তায় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ প্রোগ্রামের উদ্যোগে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের জন্য ৮৫ দিনের এবং উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য ২৮ দিনের একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু হয়েছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এর কার্যক্রম বন্ধ আছে। আশা করি, করোনা–পরবর্তী সময়ে বর্ধিত কলেবরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটি আবার শুরু হবে।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইকিয়াট্রিক নার্স ছাড়া মানসিক রোগ সেবা পূর্ণতা পায় না। দীর্ঘদিন ধরে সাইকিয়াট্রিক নার্স প্রশিক্ষণ প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন। আশা করব, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এই অতিপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ কোর্সটি শিগগির চালু হবে।

এমবিবিএস কোর্সে সাইকিয়াট্রি অনেকটাই উপেক্ষিত বিষয়। মেডিসিন কোর্সের অধীনে এর পরীক্ষা হয় এবং তাতে সাইকিয়াট্রির অংশ থাকে বেশ কম। ক্লাস, পরীক্ষায় সাইকিয়াট্রির অংশ একটি যৌক্তিক পর্যায়ে উপনীত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ইন্টার্নশিপের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মানসিক রোগসংক্রান্ত ট্রেনিংয়ে বরাদ্দ করলে একজন নবীন এমবিবিএস চিকিৎসক মানসিক রোগনির্ণয় ও প্রাথমিক মানসিক চিকিৎসা দিতে সমর্থ হবেন।

মানসিক রোগের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়নে অনেক কিছু করার আছে বাংলাদেশে। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন হলেও দেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পেতে অনেক সময় লাগবে। আর এ খাতে বাজেটও বাড়াতে হবে অবশ্যই। আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং সেসবের যথাযথ বাস্তবায়ন বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুচিকিৎসা সহজলভ্য করবে।

ডা. মোহাম্মদ আহসানুল হাবিব আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক।