Thank you for trying Sticky AMP!!

মানুষ মানুষের জন্য, রাজনীতি কার জন্য

স্বাধীনতার আগে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। পঞ্চাশের দশকে যখন দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগের তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচার স্থগিত রেখে ছুটে গেছে উপকূলের বিপন্ন মানুষগুলোকে বাঁচাতে। তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। লঞ্চ ছাড়া উপকূলে যাওয়ার কোনো বাহন ছিল না। তারপরও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সেখানে গেছেন। কেবল দলের নেতা-কর্মী নন, গেছেন ছাত্র-তরুণেরা, সংস্কৃতিসেবীরা, নারী সংগঠনের নেত্রীরা। স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় দেখেছি, ঢাকা শহরের বহু স্থানে ছাত্র ও যুব সংগঠনের উদ্যোগে রুটি তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন দলের নেতারা বন্যা উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করে সাধ্যমতো গরিব মানুষকে সহায়তা করেছেন।

এ ধারা ১৯৯৮ সালের বন্যার সময়ও অব্যাহত ছিল। ওই বছর বন্যায় ঢাকা শহরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে গেলে পিপিআরসিসহ আরও কিছু সংগঠনের উদ্যোগে অস্থায়ী স্কুল তৈরি করে শিশুদের শিক্ষা চালু রাখা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে ১৩ মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও সে রকম কোনো উদ্যোগ লক্ষ করছি না। সরকার টেলিভিশনে পাঠদান ও অনলাইনে যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

শিক্ষা দূরে থাক, দুর্গত মানুষকে বাঁচাতেও রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগ পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ গরম ছিল হেফাজতের তাণ্ডব, কোম্পানীগঞ্জে ছোট মির্জার গর্জন এবং বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান-রহস্য নিয়ে মির্জা আব্বাসের নব আবিষ্কার নিয়ে। দুই বড় দলের দুই মহাসচিবের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে সরকারের দেওয়া লকডাউনে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন দুই প্রধান দলের নেতা-কর্মীদের নির্লিপ্ততার কিছু চিত্র প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে। শুক্রবারের কলামে বন্ধু আনিসুল হক এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। এখানে আর পুনরাবৃত্তি করলাম না। করোনার সংক্রমণ প্রশমনে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু করতে না পারুক, গরিব মানুষগুলোর জন্য তো কিছু করতে পারত। জাতীয় সংসদে ৩৫০ জন সাংসদ আছেন। এই ঢাকা শহরে দুজন মেয়র আছেন। প্রতি ওয়ার্ডে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী আছেন। নির্বাচিত কাউন্সিলর আছেন। নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলর আছেন অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায়ও। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান আছেন। ইউনিয়নে চেয়ারম্যান-মেম্বার আছেন। এই দুঃসময়ে তাঁদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিপন্ন জনগণের পাশে না দাঁড়ালেও সচেতন মানুষ কিন্তু এগিয়ে আসছেন। শুক্রবার প্রথম আলোয় দেখলাম বগুড়ায় আলোর প্রদীপ নামে একটি সংগঠন উপার্জনহীন মানুষের ইফতারি ও সাহ্‌রির ব্যবস্থা করছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিদ্যানিকেতন নামের একটি প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের সপ্তাহের সাত দিন পড়াচ্ছে। ছয়–সাতটি পথশিশুকে নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০। সারা দেশে এ রকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।

২০ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে হাড়ভাঙা বৃদ্ধা, টিউশনি হারানো কলেজশিক্ষার্থী ও বেকার প্রকৌশলীর সমস্যার কথা লিখেছিলাম। দেশের ভেতর থেকে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, বাইরে থেকেও অনেক মানুষ তাঁদের সহায়তা করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কারওয়ান বাজারে এশিয়া কম্পোজিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা হাড়ভাঙা বৃদ্ধাকে দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ব্র্যাক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসানকে জানিয়েছেন, তিনিও ওই তিন ভুক্তভোগীকে সাহায্য করতে চান। তাঁদের আগ্রহ ও মনোভাব দেখে আমরা আশাবাদী হই। ভাবি, দেশের রাজনীতি যত কলুষিত হোক না কেন, এখনো মানুষের ভেতরে দয়া-মায়া, ভালোবাসা, সহমর্মিতা আছে।

করোনা সবচেয়ে বিপদে ফেলেছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোকে। এক বেলা কাজ করতে না পারলে তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। এই দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে আরেক শ্রেণির মানুষ খুব বিপদে আছেন। স্বল্প আয়ের তথা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র-তরুণেরা। এঁদের কেউ পড়াশোনার শেষ ধাপে। কেউ পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এই সময়ই অধিকাংশ তরুণ মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নেন না বা নিতে পারেন না। নিজেরা টিউশনি করে কিংবা টুকটাক কাজ করে চাকরির চেষ্টা চালাতে থাকেন। চাকরি না পেলে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু করোনাকাল তাঁদের জীবন পুরোপুরি বিপন্ন ও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।

এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘কী বলব দুঃখের কথা, আজকে উন্নত বিশ্বে স্টুডেন্ট ঋণ বলে একটা ঋণ ওখানকার ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণ মুদিদোকান থেকেও ১০০ টাকার সওদা পাওয়া যায় না ধারে। মুদিদোকানির ভাষ্য, “তুমি কামাই করো না, তোমাকে বাকি দিলে তুমি ফেরত দেবে কোথা থেকে?”’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র লিখেছেন, ‘১১ বছর আগে বাবা মারা যান। তখন থেকে আমি অনেক কষ্ট-সংগ্রাম করে পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। মাঝে একবার পড়ালেখা বাদও দিতে হয়েছে। সব বাধা পেরিয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হই ২০১৬ সালে। প্রথম দিকে একটা লাইব্রেরিতে পার্ট টাইম জব করতাম। একটা টিউশনি করতাম। লকডাউনে দুটো চাকরিই হারাই। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার কারণে মেসবাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসি।’

আরেক বেকারের আর্তি, ‘চাকরিপ্রাপ্তির সোনালি সময়গুলা চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা হচ্ছে না অনেক দিন। কত ছেলেমেয়ের বয়স ৩০ পেরিয়ে যাচ্ছে। স্যার, বয়স কি বাড়ানো হবে? এটা নিয়ে কি কিছু বলবেন?’

আরেক বাইক রাইডার লিখেছেন, ‘ঢাকায় থাকি মা-বাবাকে নিয়ে, পড়াশোনা শেষ করে ছোট একটা চাকরি করতাম। গত বছর যে মাসে বিয়ে করি, সে মাসেই করোনার কারণে চাকরি চলে গেল। নিজের একটি বাইক ছিল, সেটা নিয়ে নেমে পড়লাম রিজিকের সন্ধানে। কোনোরকমে রাইড দিয়ে চলছিল। কিন্তু লকডাউনের সময় সরকার তা-ও বন্ধ করে দিল। এ অবস্থায় কীভাবে সংসারের খরচ মেটাব, ঘরভাড়া দেব? শিক্ষা আমাকে আজ বিপদে ফেলেছে। বিবিএ, এমবিএ না করলে দোকানদারি করতে পারতাম, কারও কাছে সাহায্য
চাইতে পারতাম।’

আমাদের দেশে ঘরে-বাইরে নারীদের অনেক সমস্যা। কিন্তু তাঁরা মুখ ফুটে কিছু বলেন না। মনে কষ্ট চেপে রাখেন। পত্রিকায় পাঠকের যত চিঠি বা মেইল আসে, ৯০ শতাংশ ছেলেদের। তারপরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী লিখেছেন, ‘আমি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট মেয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও অনেক স্বপ্ন দেখেছি যে পড়াশোনা করে পরিবারের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু সে স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। ঘরে বসে আছি, বাবা হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। কী বলে তাঁকে সান্ত্বনা দেব? অনার্স শেষ হচ্ছে না ভেবে বাবা আশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি নিজে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি। শুধু আমি নই, আমার মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায় আছে। শিক্ষার্থীরা অন্যদের চেয়ে বেশি সচেতন। সরকারকে অনুরোধ করব, লকডাউন শেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। নয়তো আমাদের শিক্ষাজীবন দ্রুতই হারিয়ে যাবে।’

এই শিক্ষার্থীরা আমাদের ভবিষ্যৎ। এই তরুণেরা তাঁদের শ্রম ও মেধা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন। আমরা তাঁদের হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। দেরিতে হলেও সরকারের ঘুম ভাঙুক।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com