Thank you for trying Sticky AMP!!

মিয়ানমারের সেনাশাসনকে তিন আঙুল

আন্দোলনকারীরা তিন আঙুল প্রদর্শনের এক নতুন রীতি চালু করেছেন সেনাশাসনকে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে


পরপর কয়েক দিন ধরে দেখা গেল বেশ কিছু গাড়ি রাস্তার মাঝখানে এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে যে অন্য কোনো যানবাহনের আর এগোনোর উপায় নেই। যাঁদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর সামনের বনেটটা খোলা। ভাব দেখে মনে হয় যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে গাড়ি চলছে না। অথচ ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। সচল গাড়ি অচল করে রাস্তায় প্রতিবন্ধক তৈরি করে রেখেছেন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারীরা। তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান কিংবা পুলিশের জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের গাড়ি অথবা দাঙ্গা দমনকারী দল যেন সামনে এগোতে না পারে। সামনে কিছুটা মুক্ত এলাকা তৈরি করে সেখানেই চলছে জান্তাবিরোধী প্রতিবাদ। মিয়ানমারে দুই সপ্তাহ ধরে যেসব অভিনব ও সৃজনশীল পন্থায় আন্দোলন চলছে, এই কৌশল তার অন্যতম।

প্রতিদিন টুইটারে বিচিত্র ধরনের এসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ছবি দেখি আর বিস্মিত হই। বোঝা যায়, নতুন প্রজন্ম কতটা চটপটে, বুদ্ধিমান, সৃজনশীল, তাদের মনোবল কতটা দৃঢ়। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের আবেদন ও অংশগ্রহণে ব্যাপকতা এবার চোখে পড়ার মতো। প্রায় ৫০ বছরের সামরিক শাসনের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে রুখে দাঁড়ানোয় স্বতঃস্ফূর্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।

প্রতিবাদ জানানোর কৌশলগুলোও লক্ষণীয়। তার মধ্যে আছে নাগরিকদের ঘরবাড়ির বারান্দা ও জানালায় লাল শার্ট ঝোলানো, রাতের বেলা হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে শোর তোলা, রাজপথে স্লোগান লিখে রাখা, কূটনৈতিক দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ, সাঁজোয়া যানের সামনে হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কায়দায় বিক্ষোভ। এমনকি বিয়ের পোশাক পরা দম্পতিকেও স্বৈরাচারী শাসন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে। প্রতিবাদের আয়োজন হয়েছে মাঝনদীতেও—শতাধিক নৌকার একত্র হয়ে সামরিক শাসনবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরার ছবিগুলোও বেশ শক্তিশালী বার্তা বহন করে। বর্ণিল পোশাকে তরুণীরা ক্যাটওয়াক করে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। কিশোর-তরুণদের পোস্টারে দেখা গেছে জান্তার প্রতি স্পষ্ট বার্তা—তোমরা ভুল প্রজন্মের সঙ্গে লাগতে এসেছ।

চলমান আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো চীনবিরোধী স্লোগান ও বক্তব্য। এটিও এক নতুন সংযোজন। এমনকি চীনা দূতাবাসের সামনেও তারা প্রতিবাদের নানা অভিনব আয়োজন করে। দেশটির সামরিক নেতাদের প্রতি চীনের অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতা, তাদের নৃশংসতার ঘটনাগুলো উপেক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ঢাল হিসেবে দাঁড়ানোর ইতিহাস আন্দোলনকারীদের যে দেশটির প্রতি ক্ষুব্ধ করে তুলেছে, তা এখন বেশ স্পষ্ট। চীনের জন্য বিষয়টি রীতিমতো বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলমান প্রতিবাদের আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এমনকি গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও সক্রিয় সংহতি দেখা গেছে। বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাসরত রোহিঙ্গা যুবকেরা এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেমেছেন।

সাধারণ নির্বাচনের ফল বাতিল এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই শুরু হয় প্রতিবাদ। এখন মনে হচ্ছে, আন্দোলনটি একটি বৃহত্তর নাগরিক আইন অমান্য আন্দোলনের রূপ নিতে যাচ্ছে। রেলকর্মীরা রেলপথের ওপর শুয়ে পড়ে রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার মতো কাজও করেছেন। গৃহিণীরা রাস্তায় টহলরত সৈন্যদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, অন্যায় আদেশ তোমাদের মানা উচিত নয়। সরকারি কর্মচারীদের অনেকেও প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন। কাজ না করায় যাঁদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে রাস্তায় সহায়তা কেন্দ্র খোলার ছবি দেখা গেছে টুইটারে। গণতন্ত্রপন্থীদের সক্রিয়তায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নানা ধরনের হ্যাশট্যাগে সরগরম। এগুলোর মধ্যে হোয়াটস হ্যাপেনিং ইন মিয়ানমার হ্যাশট্যাগে সরাসরি সম্প্রচার ও প্রতি মুহূর্তের ধারাবিবরণী তুলে ধরা হচ্ছে। শুধু রাজধানী নেপিডো কিংবা ইয়াঙ্গুনের নয়, বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এসব ছবি ও খবর মুহূর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো সবই অভূতপূর্ব।

চলমান প্রতিবাদের আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এমনকি গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও সক্রিয় সংহতি দেখা গেছে। বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাসরত রোহিঙ্গা যুবকেরা এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেমেছেন। জাতিগত বৈষম্য এবং রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের জন্য কাউকে কাউকে দুঃখ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। প্রবাসে অবস্থান করা গণতন্ত্রপন্থী নেতা-কর্মীরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছে যে এনএলডিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও প্রত্যাবাসনের জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সামরিক সরকারের ভয়ভীতিমূলক নানা কৌশল—নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ে রাতের বেলায় অভিযান, প্রায় রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ রাখা, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা এবং সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক মোতায়েন—বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব ছবি ও খবর বাইরে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীরা তাঁদের সংকল্পে অটল রয়েছেন। এমনকি যেসব ব্যবসায় সামরিক বাহিনীর বিনিয়োগ আছে, সেসব বয়কটের আহ্বানও দেশটির ভেতরেই শোনা যাচ্ছে, আগে যা ছিল অনেকটাই অচিন্তনীয়। সামরিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো চাপ নিঃসন্দেহে বিক্ষোভকারীদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। তবে ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালের আন্দোলন দমনের নৃশংসতার স্মৃতি পর্যবেক্ষকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে।

আন্দোলনকারীরা তিন আঙুল প্রদর্শনের এক নতুন রীতি চালু করেছেন, যেটি প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে। সেখানেও সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাশাসনকে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ এবং গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে তিন আঙুল প্রদর্শনের চল শুরু হয়। মহামারির কারণে বছরখানেক বন্ধ থাকার পর থাইল্যান্ডেও গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন আবার শুরু হয়েছে।
গণতন্ত্রকামী এসব আন্দোলন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, বিশেষত যোগাযোগের সৃজনশীল উপায় এবং দীর্ঘায়িত সংগ্রামের জন্য দম ধরে রাখার কৌশল। আর কোনো জনগোষ্ঠীর সংগ্রামই এখন আর শুধু নির্দিষ্ট সীমান্তের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়; মিয়ানমারের আন্দোলনকারীদের সমর্থনে বিশ্বের নানা প্রান্তেই সংহতি প্রকাশের আয়োজন হয়েছে। এ আন্দোলনের পরিণতি কী হবে, স্পষ্ট হতে হয়তো আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে। তবে আন্দোলনকারীরা যে একটুও দমেননি, তা বেশ স্পষ্ট। সেনাবাহিনীপ্রধান যে বারবার বর্তমান ব্যবস্থাকে সামরিক শাসন বলতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, তা থেকে অনেকেরই ধারণা যে সেনা কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন ক্ষমতা ধরে রাখা তাঁদের জন্য কত দুরূহ হয়ে উঠছে। আন্দোলনের নতুন নতুন ভাষা ও রূপ থেকে তাই অনেকেই নাগরিক প্রতিরোধের সাফল্যের বিষয়ে ক্রমেই আশাবাদী হয়ে উঠছেন।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক