মতামত

যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন

এখন বর্ষাকাল। এ সময় প্রচুর বৃষ্টি হয়। বর্ষায় প্রকৃতি হয় আরও সবুজ। নদীগুলো জলে টইটম্বুর থাকে। কোথাও কোথাও বন্যা হয়। এ বছর তো বন্যা চোখ রাঙিয়েছিল হাওর অঞ্চলে। তবে বেশির ভাগ কৃষক মাঠের ফসল ঘরে আনতে পেরেছেন। তবে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। গত কয়েক সপ্তাহে প্রচুর বৃষ্টিপাত আর উজান থেকে আসা ঢলের কারণে সিলেট–সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার পানি একসঙ্গে বেড়ে গেলে প্রলয়ংকরী কাণ্ড ঘটে যাবে। কী যে হয়, বলা মুশকিল।

এদিকে রাজনীতিতে চলছে খরা। একদিকে রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান সরকারি দল। অন্যদিকে ছন্নছাড়া বিরোধী দল। ছোট দলগুলো কেন আছে, কী করছে, হিসাব পাওয়া কঠিন। তবে তারা আছে। সংবাদপত্রে তাদের নাম ও কথা এখনো ছাপা হয়। মূল শিরোনামটি থাকে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে নিয়েই। কারণ, এই দুটি দলই কেবল রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির চর্চা করে। বাকিরা উপগ্রহ কিংবা অলংকার। তাদের কাজকর্ম অনেকটা রিচুয়ালিস্টিক। এ দেশে অভ্যাসবশত অনেকেই রাজনীতি করেন। কেন করেন, জিজ্ঞেস করলে জবাব দেন—‘কিছু একটা তো করতে হবে।’

রাজনীতির খরা এখন সর্বগ্রাসী। মাঠে তেমন কোনো ইস্যু নেই। নানান শঙ্কা ও ঝুঁকি সামলে পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। টাকা দিয়েছে জনগণ। তৈরি করে দিয়েছে চীনা ঠিকাদার। সিদ্ধান্তটি দিয়েছে আমাদের সরকার। সেতুটির খুব দরকার ছিল। আমরা বলতেই পারি, পদ্মা সেতু শুধু গাড়িঘোড়া চলাচলের জন্য নয়, এর প্রভাব পড়বে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমের জেলাগুলোর কোটি কোটি মানুষের ওপর। টাকার অঙ্কে এই প্রকল্প ছিল এযাবৎকালে নেওয়া সবার চেয়ে ব্যয়বহুল। এ নিয়ে এখন রীতিমতো মাতম–উৎসব চলছে। এটা স্বাভাবিক। এটা থেকে সরকারি দল ‘মাইলেজ’ পাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। এখনো তার রেশ রয়ে গেছে। এদিক দিয়ে বিএনপি আছে ব্যাকফুটে। তাদের একটাই দাবি—গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন।

অনেক আগে একটা কথা শুনেছিলাম। কথাটি সম্ভবত জাতীয় সংসদে বলেছিলেন বিএনপির সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। কথাটিতে হুল, শ্লেষ ও নির্মম সত্য ছিল। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন মানে হলো পাঁচ বছর পরপর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পাঁচজন চোরের মধ্যে একটা চোরকে বেছে নেওয়া। কথাগুলো যখন বলেছিলেন, তখন দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরি হয়নি। হলে ‘খবর’ ছিল।

তাঁর কথাগুলো আক্ষরিক অর্থে নিচ্ছি না। কথাগুলোর সারমর্ম হলো, নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হন, তাঁরা ভালো মানুষ নন। একটি এলাকার নাগরিকের চোখে যিনি সবচেয়ে ভালো কিংবা যোগ্য, তিনি হয়তো কোনো দলীয় রাজনীতি করেন না বা যে দলের রাজনীতি করেন, সে দলের কস্মিনকালেও জেতার সম্ভাবনা নেই, কিংবা বড় দল করলেও মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার মতো চালাক তিনি নন।

এখানে আরও দুটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। একটি হলো টাকার খেলা, অন্যটি হলো মাস্তানতন্ত্র। এ দুয়ের মিশ্রণে যে শক্তি বা সক্ষমতা তৈরি হয়, নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে তা ধন্বন্তরির ভূমিকা পালন করে। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে এটাই সাধারণ ছবি। নির্বাচিত প্রতিনিধি মানেই তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর আশা–ভরসার মানুষ নন। তিনি একজন মন্দ লোকও হতে পারেন। বলা যায়, তিনি অন্যদের তুলনায় কম মন্দ। অথবা এমনও হতে পারে, তিনিই সবচেয়ে বেশি মন্দ, যার হাতে আছে টাকা আর মাস্তান। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে গণতন্ত্র হবে কী করে?

এখন রাজনীতিতে বাহাস চলছে মন্দ নির্বাচন বনাম ভালো নির্বাচন নিয়ে। ভালো নির্বাচন বলতে বোঝানো হয় নিরপেক্ষ নির্বাচন, যে নির্বাচনের ফলাফলে ভোটদাতার বাইরে আর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। এ রকম একটি নির্বাচন হলেই কি আমরা গণতন্ত্র পেয়ে যাব? আমরা কি এক সেট মন্দ লোকের হাত থেকে আরেক সেট মন্দ লোকের হাতে পড়ব না? স্বভাবতই কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন—তাহলে আমরা কি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে সোচ্চার হব না?

গণতন্ত্রের যে অবয়বটি আমরা কাগজে–কলমে দেখি, তা এসেছে টেমস নদীর পার থেকে বুড়িগঙ্গায়। রাজনীতির পদ্ধতিটি এসেছে, তার সংস্কৃতিটি আসেনি। এটি বাইরে থেকে আনা যায় না। ভেতর থেকে জন্মাতে হয়। মানুষের মন যে রকম, তার ধারণা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিষ্ঠানও হবে সে রকম। আমরা এ দেশের মানুষ হিসেবে যে রকম আছি, আমাদের নেতা পয়দা হয় সে রকমই এবং প্রতিষ্ঠানও হয় সে রকম। নেতা তো আর চৌথা আসমান থেকে টুপ করে নেমে আসেন না? তবে একটা জিনিস খেয়াল করার মতো। এখানে যিনি নেতা, তিনি নিজেকে জাহির করেন একজন ‘মসিহ্’ হিসেবে। তিনি ত্রাণকর্তা। তিনি আছেন বলেই আমরা ‘ভালো’ আছি। তিনি না থাকলে ঘোর অন্ধকার। তাই আমরা চেঁচিয়ে বলি, ‘নেতা তুমি এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’। নেতাও একসময় ভাবতে থাকেন, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা, তিনি সব বালা–মুসিবত দূর করবেন, তিনি অপরিহার্য।

রাজনীতির এ রকম একটা ‘সিনড্রোমের’ মধ্যে আমরা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার বদলের কথা ভাবি। একসময় কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতিতে একটা সরল বাক্য ছিল—বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির মধ্যে নানান বিভাজন থাকলেও জনগণকে শোষণ করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। আমরা এ কথাটি আরও ছোট ও সহজ করে বলি—মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা মুদ্রার পিঠ বদলই দেখব। মুদ্রা বদলাবে না।

কমিউনিজমের কথা এখন সজোরে কেউ আর বলেন না। তাঁরা নিজেদের এখন ‘বাম’ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁরা ওই মুদ্রাকে এখন আর বর্জনের কথা বলেন না। কেউ গাঁটছড়া বাঁধেন এপিঠের সঙ্গে, কেউ যান ওপিঠের সঙ্গে। ‘বুর্জোয়া’ গালিটাও এখন তেমন আর শোনা যায় না। তার বদলে একটা কথা ‘বামদের’ মুখ দিয়ে প্রায়ই বের হয়—বাজার অর্থনীতি। এটাই নাকি সব নষ্টের মূল। আমি জানি না, এর বাইরে বিকল্প কোনো অর্থনীতি পৃথিবীর কোথাও এখন আছে কি না।

কথা শুরু করেছিলাম রাজনীতির খরা নিয়ে। সে প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। মাঠে জুতসই তেমন কোনো ইস্যু নেই। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। তারা এখন উন্নয়নের রাজনীতির কথা বলে। বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। তারাও একসময় সরকারে ছিল। তখন তারাও উন্নয়নের রাজনীতির কথা বলত। মনে পড়ে, এ দেশে ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ প্রবচনটি প্রথম চালু করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।

কথা হচ্ছে রাজনীতির ইস্যু নিয়ে। কেউ তো বলতে পারবে না—আমি উন্নয়ন চাই না। এখানে একটা কথা বেশ চাউর হয়েছে—উন্নয়নও চাই, গণতন্ত্রও চাই। উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের মধ্যে আমি তেমন বিরোধ দেখি না। তবে তার অর্থ অনেক পাল্টে গেছে। উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। প্রকল্প মানেই টেন্ডার। টেন্ডার মানেই ঠিকাদার। গণতন্ত্রের সঙ্গেও টেন্ডারবাজি আর ঠিকাদারি জড়িয়ে আছে। এখানে ঠিকাদার হলো রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ইশতেহার নাম দিয়ে টেন্ডার তুলে ধরে জনগণের কাছে। সেখানে সুন্দর সুন্দর কথা লেখা থাকে।

এ দেশে টেন্ডারশিল্প বেশ পুরোনো হলেও দিন দিন তার অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। টেন্ডার এখন ছিনতাই হয়। অনেক জায়গায় দেখা যায়, গুটিকয় ঠিকাদার একটা সিন্ডিকেট বানিয়ে অন্য ঠিকাদারদের হঠিয়ে দেন। এমনও আছে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা রফা করে কেউ একক টেন্ডারদাতা হিসেবে মাঠে বহাল থাকেন। নির্বাচনের রাজনীতিতে এর আসর ভালোই পড়েছে। এখানেও সিন্ডিকেট ছিনতাই এবং ‘সোল সোর্সিং’ বা একক টেন্ডারদাতা। ইদানীংকার নির্বাচনগুলোতে এসব আলামত বেশ স্পষ্ট।

এ রকম একটি অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো কী নিয়ে মাঠে নামবে। একটা স্থূল উদাহরণ দিই। আমার বাসার সামনের রাস্তার সংস্কার হবে। সে জন্য একটা

প্রকল্প তৈরি হলো। টেন্ডার জমা দিল একাধিক প্রতিষ্ঠান। কাজ পেল একটি। ওই ঠিকাদারের লোকেরা কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের কাজ করবে? এখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই। আমি বছর বছর খাজনা দিই। ওই টাকায় প্রকল্প হয়, টেন্ডারবাজি হয়, উন্নয়ন হয়, আমার টাকায় বানানো প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষে মোনাজাত; ফিতা কাটা—সবই হয়। নির্বাচনের বেলায়ও এ রকমটি ঘটে। আমি কেবলই ভোটার। যদিও সংবিধানে গালভরা একটা বাক্য আছে—দেশের মালিক জনগণ। আমি ভোটটি দিয়ে দিলেও (বা দিতে পারলে) যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক