Thank you for trying Sticky AMP!!

রাস্তায় বিড়ম্বনা, রাস্তার বিড়ম্বনা

ফাইল ছবি

আমি নির্বিবাদী মানুষ। প্যাঁচ বুঝি না। কিন্তু কপাল খারাপ। রাস্তায় বেরোলেই কোনো না কোনো প্যাঁচে জড়িয়ে যাই। যেখানে সমস্যা থাকার কথা না, সেখানেও সমস্যায় পড়ি। রাস্তাঘাটে আইনকানুন মানলে ঝামেলায় পড়ার কথা না। কিন্তু নিয়ম মানার পরও ‘প্যাঁচ’ আমাকে ছাড়ে না। মাঝেমধ্যেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। সমস্যাটা আসলে কি আমার, নাকি নিয়মের—ধন্দে পড়ি। ফিরিস্তি দিই:

১. মাঝেমধ্যে আমাকে অভ্যন্তরীণ বিমানে ভ্রমণ করতে হয়। কখনো কখনো সঙ্গে হাতব্যাগটি পর্যন্ত থাকে না। হয়তো সে কারণেই বিমানবন্দরে ধাতব নিরাপত্তা ফটকে প্রবেশের আগেই নিরাপত্তা প্রহরী আমাকে দাঁড় করান। আমার প্রতি তাঁদের যথেষ্ট সন্দেহ হয়। শেষমেশ অবশ্য ‘জেরার মুখে’ আমার গোবেচারা আচরণ দেখে তাঁরা ছেড়ে দেন।

২. আমার গ্রামে যেতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ত্বরা সেতু পার হতে হয়। আমার গাড়ি নিয়ে স্বজনদের কেউ সেতুটি পার হলে টোলঘরের কাছে এসে তাঁরা জানিয়ে দেন, সেটি আমার গাড়ি। গাড়ির মালিকের পরিচয় পেয়ে টোল মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গাড়িতে যদি আমি থাকি, তাহলে কালবিলম্ব না করে টোলের পয়সা দিয়ে দিই। নিজের পরিচয় না দিয়ে গাড়ির মালিকের নাম অমুক (আসলে নিজের নাম) বললে সম্ভবত তাঁরা টোল নিতেন না। তখন মনে হয়, তাঁরা হয়তো আমাকে নয়, আমার গাড়িটাকেই সম্মান করেন।

৩. ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত ভাইকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসছিলাম। পথে গাড়িতে গ্যাস নেওয়ার প্রয়োজন। গরমের সময়, তার ওপর লম্বা লাইন। সাধারণত যেকোনো কাজে লাইনে যথাক্রমিকে সেবা পেলে আমি নিজেকে নিয়ে রীতিমতো গর্ববোধ করি, কিন্তু এবার তো লাইনের আগেই সেবা চাইতে হবে। যথেষ্ট অপরাধবোধ নিয়েই গ্যাস স্টেশনে কর্তব্যরত একজনকে বিষয়টি বললে তিনি আমাকে জানালেন, আমার আগে যাঁরা লাইনে আছেন, তাঁদের প্রত্যেকের থেকে আমাকে অনুমতি নিতে হবে। এত লোককে বোঝাতে পারব—এ রকম সৎ সাহসের অভাবে গন্তব্যের দিকে গ্যাস ছাড়াই রওনা হতে হলো। 

৪. রাজধানীতে বেশ কিছু পদচারী-সেতু হয়েছে। কিন্তু সবাই তা ব্যবহার করছে না। আমাদের ট্রাফিক পুলিশই ওভারপাসের নিচে যাত্রীদের রাস্তা অতিক্রম করতে সাহায্য করছে, ওভারপাস ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে না। আগে বাসে ভাড়ার তালিকা থাকত। এখন থাকে না এবং অধিকাংশ সময়েই ভাড়ার দর-কষাকষিতে বাসচালকদের কাছে সাধারণ যাত্রীদের পরাজয় ঘটে। অবশ্য শুধু সাধারণ যাত্রীরা নন, এমনকি সরকারকেও বাসের মালিকদের দাবির মুখে পিছিয়ে আসতে হয়। 

৫. গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুরে গ্যাসের স্টেশনে দাঁড়িয়েছি। লাইনে ১১-১২টি গাড়ি। এরই মধ্যে এক তরুণ গাড়ি সরাসরি গ্যাস দেওয়ার জায়গায় দাঁড়া করাল। কর্তব্যরত কর্মচারী দ্রুত তাকে গ্যাস দিলেন। সে চলে যাওয়ার পর ওই কর্মী বললেন, গ্যাস না দিলে সে কর্মীদের মারত। পরে জানতে পারলাম, ছোকরাটি সাভার পৌরসভার একজন সম্মানিত কাউন্সিলরের মহাসম্মানিত গাড়িচালক।

৬. যেতে হবে গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাস্তায় যানজটের কথা ভেবে রেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং কমলাপুর থেকে একটি টিকিট কাটারও ব্যবস্থা করা হলো সম্ভবত জামালপুর এক্সপ্রেসে। টিকিটের দাম খুবই কম, সঙ্গে সিট নম্বরও নেই। আমাকে জানানো হলো, সিট নম্বর থাকে না—প্রকৃতপক্ষে টিকিটের গায়ে সিট নম্বর দেওয়ার সুযোগও নেই। যা হোক, আগে যাওয়ার ফলে সিট একটি পেয়েও গেলাম। ট্রেন কিছুক্ষণ চলার পর এক কৃশকায় নারী এলেন এবং অন্যান্য সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ করে স্থির করলেন, আমি তাঁর সিটে বসেছি। আমি বললাম, আমি যে টিকিট কিনেছি, তাতে তো সিট নম্বর নেই। তাঁর টিকিটেও দেখি সিট নম্বর নেই, তবে খুবই আনাড়ি হাতে একটি সিট নম্বর টাইপের কিছু লেখা আছে। আমি বললাম, এমন হাতের লেখার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, আমি এর থেকেও সুন্দর করে আমার টিকিটে একটি সিট নম্বর লিখে নিতে পারি। তবে ওই রকম সিট নম্বর লেখা আরও কয়েকজন জোট বেঁধে গেল এবং আমাকে ইচ্ছামতো তাদের ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকল। তাদের জন্য একমাত্র যে কটু কথাটি আমি উচ্চারণ করলাম, তা হলো নিশ্চয়ই আপনারা একজন বড় মাপের মানুষকে কিছুটা উৎকোচ দিয়ে লিখিয়ে এনেছেন। তবে অবস্থা বেগতিক দেখে এবং কয়েক দিন আগেই ট্রেনে এক নারীকে ছেলেধরা নাম দিয়ে মারতে মারতে মেরে ফেলার কথা মনে পড়ায় সিট ছেড়ে দিতেই হলো। 

৭. বাসার কাছের একটি গলি থেকে নতুন মুদ্রিত কিছু বই নিতে হবে। রাত প্রায় ১০টা। বইগুলো নিয়ে বাসায় চলে আসব। এমন সময়ে জানলাম, যতক্ষণ গলির বাসিন্দা এক নেতা বের না হবেন, ততক্ষণ রাস্তা দিয়ে কেউ যেতে পারবে না। তাঁর বাহিনী রাস্তা আগলে রেখেছে। আমার ভাগ্য ভালো, আধা ঘণ্টার মধ্যেই এই অনিশ্চয়তার অবসান হলো। ভাবলাম, একটি দুর্ঘটনা হলে, হৃদ্‌রোগের সমস্যা হলে কী হতো? কয়েক দিন আগে এক গাড়িচালকের থেকে জানতে পারলাম, এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের এলাকাটি নিজেদের মতো করেই ব্যবহার করেন। 

৮. জাজিরায় একটি অনুষ্ঠানে যেতে হবে। ফেরির সময় অনুযায়ী উপস্থিত হলাম, যদিও ফেরি ছাড়ার জন্য ফেরিচালককে বিন্দুমাত্র আগ্রহী মনে হলো না। জানা গেল, স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি আসবেন। নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবা গেল না; কারণ, অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর কেবল তাঁর গাড়ির সঙ্গে নদী পারের সুযোগ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে হলো। 

৯. যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানীতে উল্টো লেনে ক্ষমতাশালী নাগরিকদের যানবাহন চলে যানজট পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে অতিসম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছেন যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে আর কেউ যেন নিজেকে ভিআইপি না ভাবেন। এরপরও তো রাজধানীর সড়কে ভিআইপির কোনো অভাব নেই। এটা কি হাইকোর্টের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন, না আইনকে অবজ্ঞা করে চলা? অবশ্য যানজটে নাকাল রাজধানীতে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন করার প্রস্তাব যে দেশের কর্তাব্যক্তিদের থেকে আসে, সেখানে হাইকোর্টের উপদেশ কে শুনতে যাবে? 

১০. অতিসম্প্রতি অভিযোগ উঠেছিল, প্রজাতন্ত্রের এক কর্মচারীর জন্য বিলম্বে ফেরি ছাড়ার ফলে একটি কিশোর যথাসময়ে চিকিৎসার অভাবে মারা গেল। গঠিত তদন্ত কমিটি অবশ্য কর্মচারীর কোনো দোষ খুঁজে পায়নি, যদিও তিনি বারবার ফেরির কর্তাব্যক্তির সঙ্গে ফোনালাপ করেছিলেন। পরিশেষে হয়তো জনক্ষোভ হ্রাসের জন্য কোনো ছোট আয়ের, ক্ষমতার একজন অতিসাধারণ নাগরিককে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। 


মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস