Thank you for trying Sticky AMP!!

রায় নিয়ে উত্তেজনা দুর্ভাগ্যজনক

প্রবল বন্যায় জনপদ বিপর্যস্ত হলে অথবা জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোনে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বিধ্বস্ত হলে কিংবা কালবৈশাখীতে সবকিছু লন্ডভন্ড হলে, এমনকি ভূমিকম্পে একটি দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও তার পুনর্গঠন সম্ভব। ধীরে ধীরে আবার সেই জনপদ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সেখানকার জীবন নতুন করে শুরু হয়। সেখানে ওঠে নতুন বাড়িঘর। মানুষ সাজায় নতুন করে ফুল ও ফলের বাগান। কিন্তু কোনো জাতির বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতার জায়গাটা যদি তছনছ হয়ে যায়, তাহলে দু-এক শ বছরেও তা স্বাভাবিক হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। সে জাতির পতাকা থাকে, জাতীয় সংগীত থাকে, জাতীয় প্রতীক থাকে, কিন্তু স্বাধীন সত্তা ও মর্যাদা বলে কিছু থাকে না।

বাংলাদেশের মানুষ এক হিংস্র সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে এ দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করেছিল। সেই সেনাবাহিনীর তুলনায় খুব অল্পই অস্ত্রশস্ত্র ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা ছিলাম ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল আমাদের যুক্তি। সেদিনের প্রতিরোধযুদ্ধে জয় হয়েছিল সত্য ও যুক্তির। সেদিন একটি দুর্ধর্ষ ও নিকৃষ্ট শত্রুকে পরাজিত করা সম্ভব হলেও আজ আমরা নিজেদের কাছেই নিজেরা পরাজিত হচ্ছি। নিজের কাছে নিজের পরাজয় খুব বড় পরাজয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুলভ্রান্তির ভেতর দিয়েই একটি জাতি সমৃদ্ধ হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় ঘোষণার পর সরকারি দল ও বিরোধী দল থেকে যে প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে, তা দলনিরপেক্ষ অথবা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের বিস্ময় ঘটায়। রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে যদি কোনো পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকে, তা তারা প্রকাশ করতেই পারে। মতামত প্রকাশ করা আর আনন্দ প্রকাশ বা উত্তেজনা প্রকাশ দুই জিনিস। সরকারি দল অসন্তুষ্টি বা ক্ষোভ প্রকাশ করতে না করতেই বিরোধী দল আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। সরকারি দলের কী কারণে ক্ষোভ, তা বোঝা গেলেও বিরোধী দলের কী জন্য আনন্দ, তা বোঝা গেল না।

রাষ্ট্র যদি আজ স্বাভাবিক থাকত, তাহলে যা হতে পারত তা হলো পূর্ণাঙ্গ রায়টি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে কোন জায়গায় কার ভিন্নমত বা আপত্তি আছে, তা লিখিতভাবে সর্বোচ্চ আদালতকে জানানো। পুনর্বিবেচনার জন্য ‘রিভিউ’র আবেদনও করা যেত। সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিসহ সাতজন বিচারপতির রায় নিয়ে মাঠে-ঘাটে মেঠো বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া কতটা সমীচীন, তা বক্তারা ভেবে দেখেছেন কি? অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাদের বগল বাজানো ভাবটা কতটা বুদ্ধিপ্রসূত আর কতটা বোকামিপ্রসূত, তা তাঁরা এখনো উপলব্ধি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। দীর্ঘ রায় পাঠ করার সময় তাঁদের কম, তাই না পড়েও বলতে পারতেন, ‘রায় যথার্থ। এ নিয়ে বলার কিছু নেই।’ আর সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে কথা বলতেই হবে কেন?

এখনো বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে চলছে। সংবিধানের প্রথম তিন অক্ষরের শব্দটি ‘আমরা’, তার পরে একটি কমা দিয়ে লেখা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ’। এই তিনটি শব্দে যা বলার তা বলা হয়ে গেছে: বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সংবিধানের ভাষায়, ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’। এই প্রজাতন্ত্রে ‘আমিত্ব’ নয়, ‘আমরাত্ব’ই প্রাধান্য পাবে, সে কথা মূল সংবিধানেই বলা আছে। সুতরাং সংবিধানের এই প্রশ্নে বিতর্কের কোনো সুযোগই নেই।

দুনিয়ার অন্যান্য রিপাবলিকের মতো বাংলাদেশেরও তিনটি প্রধান বিভাগ রাষ্ট্র পরিচালনা করছে: নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ। এই তিন বিভাগের সমন্বিত কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্র চলছে। এর যেকোনো একটি বাদ দিলে অন্য দুটি অসম্পূর্ণ। এর কোনোটিই কারও চেয়ে ছোট বা বড় নয়। তবে নির্বাহী বিভাগের কাজ খুব বেশি। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী। তিনি সংসদ সদস্যদেরই একজন এবং সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে তিনি দুবার নির্বাচিত। একবার জনগণের সরাসরি ভোটে এবং দ্বিতীয়বার সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে।

একটি কথা আমাদের দেশে খুব বেশি ধ্বনিত হয়, তা হলো ‘সংসদ সার্বভৌম’। কিন্তু জনগণ দেখেছে দেশে অনেক সময় সংসদ ছিলই না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো সংসদ ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্র চলেছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলেছে। থানা-পুলিশ, আইন-আদালত চলেছে। তবে ওই সময়ের নির্বাহী বিভাগে প্রাধান্য ছিল সামরিক শাসনের—সাংবিধানিক নয়।

সংসদের সভাপতি বা প্রধান হলেন স্পিকার এবং বিচার বিভাগের প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে  ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’। প্রধান বিচারপতি হলেন ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’। তিনি রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি—এই তিনজনকে কোনোক্রমেই অমর্যাদা করা যায় না। এই তিন বিভাগের প্রধানকে নিয়ে মাঠে-ঘাটে যেখানে-সেখানে অসুন্দর ভাষায় বক্তব্য দেওয়া ঘোরতর অন্যায়। তাতে তাঁদের ওই বিভাগকেই অমর্যাদা করা হয়। তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে।

রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধান দ্বারা, কিন্তু দেশ ও সমাজ চলে অলিখিত রীতিনীতি ও নৈতিক নিয়মে। সম্ভবত কোনো দেশের শাসনতন্ত্রেই এ কথা লেখা নেই যে অন্যকে সম্মান করতে হবে, যদি কোনো নাগরিক তা না করে, তাহলে তাকে বিশেষ মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে। এই যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সসম্মানে কথা বলা উচিত—এ কথা স্বাধীন দেশ হোক, পরাধীন দেশ হোক অথবা আশ্রিত রাষ্ট্র হোক—সব দেশের সব নাগরিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

কোনো সাংবিধানিক পদে আসীন কোনো ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু সেই সমালোচনা অসংযত ভাষায় হতে পারে না। সমালোচিত ব্যক্তি কোন ধর্মের, কোন বর্ণের ও কোন সম্প্রদায়ের মানুষ—এ প্রশ্ন তোলা শুধু অর্বাচীনতা নয়, ঘোরতর বর্ণবাদিতা। বর্তমান বিশ্বে বর্ণবাদ একটি অপরাধ। রাষ্ট্রের কোনো বিষয়ে আলোচনা হবে বিষয়বস্তুভিত্তিক—ব্যক্তিকে আক্রমণ করে নয়। কোনো পদের কোনো মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধির পরিমাণ তার গায়ে লেখা থাকে না। তা পরিমাপের কোনো যন্ত্র নেই। সুতরাং তা নিয়ে মাঠে-ময়দানে প্রশ্ন তোলাও অনুচিত। আমাদের সংবিধানেও ‘মানবিক মর্যাদা’ শব্দটি আছে। যখন আমরা কোনো ব্যক্তিকে অসম্মান করি, তখন সংবিধানকেও অসম্মান করি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই আজ অফিস-আদালত, সরকারি দপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর প্রেমিকে ভরে গেছে। পঁচাত্তরের পর তাঁর স্মরণে এবং তাঁর দুই কন্যাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কে কী করেছিলেন, সে তথ্য জানতে চাইলে অতি অল্প কিছু মানুষই তা সরবরাহ করতে পারবেন। বাংলার মাটিতে বসন্তের কোকিল নতুন প্রজাতি নয়। দুর্দিনে খুব কম ব্যক্তিকেই পাওয়া যায় পাশে। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে, এমন মানুষ দুনিয়াতে একজনও আছে—নির্বোধ ছাড়া তা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাঁর ভূমিকার মূল্যায়ন সবাই সমানভাবে করবে না। তবে তাতে তাঁর মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় না। কপটদের বাদ দিলেও তাঁকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসে, এমন মানুষ অতীতের মতো বর্তমানেও অগণিত। তাঁর মৃত্যুর পর কত লোক তাঁর নামে কোরবানি দিয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে আমি চিনি। তাঁরা কোনো প্রাপ্তির আশায় তা করেননি।

আজ লাখ লাখ ব্যানার ও পোস্টার করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ছবির সঙ্গে নিজেদের ছবি দিয়ে। এক-এগারোর সময় তিনি যখন বন্দী এবং দুই নেত্রীকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র হয়, তার প্রতিবাদে মানববন্ধনে দাঁড়ানোর মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। দুঃসময়ে যারা পাশে থাকে, তারা এক রকম, আর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যারা স্লোগান দেয়, তারা অন্য রকম। ক্ষমতাসীনদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে আসল আর নকল নির্ণয় করা কঠিন। আজ যে পক্ষে আছে, স্বার্থে আঘাত লাগলেই কাল সে বিপক্ষে যেতে দ্বিধা করবে না। সেটাই মানুষের স্বভাব।

ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে অসংযম ও উত্তেজনার প্রকাশ ঘটছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এতে জাতির খুব বড় ক্ষতি হতে পারে। রাষ্ট্রের সব বিভাগ সমন্বয় করে কাজ করবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কোনো বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে যায়। রাষ্ট্র দুর্বল হলে বাইরের শক্তি এবং ভেতরের অপশক্তি মাথাচাড়া দেয়। আমাদের সবার অসংযত আচরণে রাষ্ট্র ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এরপর বৈদেশিক শক্তি যদি বলে, তোমরা দেশ চালাতে পারো না। কী জবাব দেব?

আজ আমরা যারা বিভিন্ন বিষয়ে হট্টগোল করছি ব্যক্তিস্বার্থে, সময়ের স্রোতে আমরা খড়কুটোর মতো ভেসে যাব। কিন্তু যে বিশ্রী নোংরা রেখে যাচ্ছি স্তূপ করে, তা পরিষ্কার করবে কে? কয়েক প্রজন্মের পরের মানুষ বলবে, একটা সময়ে কী সব মানুষ এ দেশে ছিল রে বাবা! তাদের মধ্যে সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা ও পারস্পরিক সম্মানবোধ বলে কিছু ছিল না!

একটা সময় পর্যন্ত ছিলাম আমরা ও তারা। তাদের তাড়িয়েছি একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর। তারপর থেকে শুধু ‘আমরা’। আমরা বলতে দেশের সব দলের, সব ধর্মের, সব জাতিসত্তার সব মানুষ। আমরা বললে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকে না। আমরা বললে লোপ পায় সব ভেদাভেদ।

সুস্থ ধারার রাজনীতিই পারে ‘আমরা’ শব্দটিকে অর্থপূর্ণ করতে। মতপার্থক্য আর বিভেদ এক জিনিস নয়। মতপার্থক্যে জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয় না। একটি ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকে মতপার্থক্য থাকবেই। সেটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। প্রজাতন্ত্রের সব সাংবিধানিক বিভাগ নিয়েই ‘আমরা’। সবার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে ‘আমরা’ হওয়া যায় না। আমাদের জীবনে সংবিধানের প্রথম শব্দ ‘আমরা’ অর্থবহ হোক, এই প্রত্যাশা করি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।