ধর্ষণের শিকার লাভলী আক্তার (১৮) ধর্ষককে বিয়ে করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তবে বিয়ের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় জীবন দিতে হলো তাঁকে। গত অক্টোবরে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্কুলছাত্রী লাভলীকে ধর্ষণের অভিযোগে লাভলীর মায়ের করা মামলায় জেলে যান ধর্ষক আবদুর নুর। কারাগারে থাকা অবস্থায় লাভলীকে বিয়ে করতে রাজি হন তিনি। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে গত নভেম্বরের শেষ দিকে বিয়ে করেন। আর গত শনিবার রাতে শ্বশুরবাড়িতে মৃত্যু হয় লাভলীর। পুলিশ যখন লাশ উদ্ধার করে, তখন লাভলীর গলায় ওড়না প্যাঁচানো ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধরের চিহ্ন ছিল। লাশ বিছানার ওপর পড়ে ছিল।
নিহত লাভলীর মা আঙুরা খাতুন ৩০ জানুয়ারি রাতে বাহুবল থানায় মামলা করেছেন। এবার করেছেন হত্যা মামলা। এ মামলায় লাভলীর স্বামী বর্তমানে কারাগারে।
১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ‘ধর্ষণ মামলা থেকে বাঁচতে বিয়ে, এরপর হত্যা!’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লাভলীর খবরটি ছাপা হয়।
১ ফেব্রুয়ারি একটি অনলাইনে প্রকাশিত আরেকটি খবরে চোখ আটকে যায়। খবরটি ছিল বরিশালে ধর্ষণ ও ভ্রূণহত্যাচেষ্টার অভিযোগে এক যুবককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুর ২১ বছর বয়স পর্যন্ত যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ আদেশ বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে কাগজপত্র যাবে এবং জেলা প্রশাসনই কার মাধ্যমে, কীভাবে শিশুটির ভরণপোষণ নিশ্চিত করা যায়, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। বরিশালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শেখ আবু তাহের আসামির অনুপস্থিতিতে এ রায় দেন।
বরিশালের এই তরুণী ও পরে মামলার বাদীর (২৬) সঙ্গে প্রতিবেশী বজলুর রহমান হাওলাদারের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তিনি তরুণীকে ধর্ষণ করেন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিয়ের পোশাক কেনার কথা বলে বজলুর তরুণীকে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেন এবং ভ্রূণহত্যার কথা বলেন। তরুণী কৌশলে পালিয়ে যান। ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ওই তরুণী বাদী হয়ে বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি মামলা করেন। ওই কন্যাশিশুর বয়স এখন চার বছর।
গত বৃহস্পতিবার লাভলীর মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার সময় ঢাকায় বসে ফোনের এ প্রান্ত থেকেও তাঁর বুক চাপড়ানোর আওয়াজ পাচ্ছিলাম। বারবার বলছিলেন, অসহায় ছিলেন, তাই ধর্ষকের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এতে করে মেয়েটা বেঁচে যাবে। তিনি নিজে দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে বেঁচে যাবেন। স্থানীয় মুরব্বিরা বুঝিয়েছিলেন মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেখার জন্য। ভালো করে সংসার করলে তো ভালোই, তা না হলে আবার মামলা তো করাই যাবে। মেয়ে হারিয়ে আঙুরা খাতুন বলছিলেন, ‘মাইয়্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কইরা বিয়া দিছি। এর আগে কতজনের কাছে বিচার চাইছি। বিচার পাইছি না। বিচার পাইলে আমার বুকটা খালি হইত না।’
আঙুরা খাতুনের যে আহাজারি, তাতে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা নেই। কোনো সান্ত্বনাতেই এ জীবনে তাঁর বুক চাপড়ানো থামবে না।
প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে, লাভলী না ওই তরুণীর সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল? দুটোই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তাঁরা দুজনই বিশেষ পরিস্থিতির শিকার। একজন ধর্ষককে বিয়ে করে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারলেন না। আরেকজন আইনি আশ্রয় নিয়ে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ভরণপোষণের একটি বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন। ধর্ষকের শাস্তির আদেশ হয়েছে।
লাভলী বা তাঁর মা আইনি আশ্রয়ে অটল থাকলে হয়তো ওই ধর্ষকেরও একদিন না একদিন সাজা হতো। কিন্তু সেই সমাধানে যেতে পারেনি লাভলীর পরিবার।
সরকার এই ধরনের বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর ১৯ নম্বর ধারায় ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হতে পারবে বলে বিধান রেখেছে। এ ধারাসহ খসড়াটি গত ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে আইনের ১৯ ধারায় উল্লেখিত বিশেষ বিধানের ব্যাখ্যা সম্পর্কে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ ও মা-বাবার সম্মতিতে অনুষ্ঠিত বিয়ে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, অবিবাহিত মা বা অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বেলায় এই বিধান প্রযোজ্য হবে।
মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরাও বারবার বলছেন, এ বিশেষ ধারা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শিশুদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। লাভলী ও লাভলীর মা আঙুরা খাতুন কি এই রক্ষাকবচই চেয়েছিলেন?