Thank you for trying Sticky AMP!!

শিক্ষায় কি প্রাণের উজ্জীবন সম্ভব?

সাধারণ প্রত্যাশা, শিশু-কিশোরের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার যথার্থ স্থান বিদ্যালয়। বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যালয় কী করতে পারে, সমাজ সেই সীমারেখা টেনে দেয়। সমাজের বাস্তবতা কি বিদ্যালয়ের কাজ অসম্ভব করে তুলেছে?

গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে এডুকেশন ওয়াচ ২০১৭ গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয় ‘বিদ্যালয়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা’। ৯ মে প্রতিবেদনটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আটটি বিভাগের ৬৪টি সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে জরিপ করা হয়েছে। একটি মূল্যবোধ জরিপপত্রের সাহায্যে ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থী, ৫৭৬ জন শিক্ষক এবং স্কুল কমিটির ১ হাজার ২৮০ জন সদস্য ও অভিভাবকের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে।

মূল্যবোধ জরিপের উত্তরদাতাদের ৪৭টি বক্তব্য সম্বন্ধে মত জানাতে বলা হয়েছে। তাঁরা জানাতে পারেন তাঁদের সহমত বা দ্বিমত অথবা বলতে পারেন ‘কোনো মত নাই’। এই বক্তব্যগুলো ছিল নৈতিকতা-মূল্যবোধের নয়টি নির্ধারিত ক্ষেত্র নিয়ে-ব্যক্তিগত বিশ্বাস; আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক; কমিউনিটি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্যের ভূমিকা; মানবতার অংশ ও বৈশ্বিক নাগরিকের ভূমিকা; ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন; পরিবেশ ও পৃথিবী রক্ষা; জেন্ডার সমতা ও ন্যায্যতা; শিশুদের প্রতি মনোভাব এবং মূল্যবোধ ও নৈতিকতাসংক্রান্ত কর্মোদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ।

প্রত্যাশিতভাবে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর নৈতিকতা-মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রভাব নেতিবাচক। এক নির্দেশাত্মক পাঠদান প্রক্রিয়া, অর্থাৎ কী ঠিক এবং কী করতে হবে, তা বলে দেওয়া বিদ্যালয়ের বিদ্যমান রীতি। পাঠে বা সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রদের নৈতিক আচরণের চর্চা বা চিন্তাভাবনার সুযোগ সামান্য। মুখস্থবিদ্যা-নির্ভরতা এই প্রক্রিয়ার অংশ।

‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ নামক বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদাভাবে পড়ানো হয়। এভাবে ভিন্নতা ও বিভেদের ধারণাকে উৎসাহিত করা হয়। দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যালয়েই ভৌত পরিবেশ, শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ, সহশিক্ষাক্রমের সুযোগ ইত্যাদি শিক্ষার্থীর সুশিক্ষা ও নৈতিক-মূল্যবোধ গঠন চর্চার অনুকূলে নয় বলে দেখা গেছে। বারবার যে বিষয়টি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের উত্তরে উঠে এসেছে, তা হচ্ছে বৃহত্তর সমাজ ও পরিবারে নৈতিকতা-মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিকতা শিক্ষা ও চর্চাকে বিস্তর বাধার মুখে ফেলেছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, অভিভাবক ও শিক্ষকদের যোগসাজশে ছাত্রদের পরীক্ষায় অসদুপায় গ্রহণ ও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের পেছনে ছোটা। শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়া ও কোচিং সেন্টারে যেতে ছাত্রদের বাধ্য করছেন।

মার্কিন সমাজ মনস্তত্ত্ববিদ লিওন ফেসিটনজারের (Leon Festinger) এক তত্ত্ব-উপলব্ধির দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধিতা (cognitive dissonance)। মানুষ জেনে বা না জেনে একই সঙ্গে স্ববিরোধী ধারণা বা বিশ্বাস পোষণ করে, যা তাদের অন্যায় আচরণের দিকে ঠেলে দেয়। এই পরিস্থিতে মানসিক স্বস্তির জন্য স্ববিরোধী চিন্তা বা বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয় বা তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। মূল্যবোধ জরিপে উপলব্ধির স্ববিরোধিতা বা দ্বন্দ্বের অনেকগুলো উদাহরণ পাওয়া গেছে।

৮৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, মানবজীবনে একটি ‘বৃহত্তর লক্ষ্য’ আছে। কিন্তু ৮৩ শতাংশ জানিয়েছেন, বিত্তশালী হওয়া ও খ্যাতি অর্জন করা সচ্ছল জীবনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ৯১ শতাংশ মনে করেন, ভাষা, নৃগোষ্ঠী, অঞ্চল, ধর্মসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিটি মানুষের বহুমাত্রিক পরিচয় রয়েছে। অথচ তিন-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ধর্মীয় পরিচয়ই মানুষের আসল পরিচয়।

৮৫ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের অসদুপায় অবলম্বন গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু অর্ধেক উত্তরদাতা মনে করেন, ‘সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’ এই নীতি বর্তমান সমাজে বাস্তবসম্মত নয়। প্রায় ৯০ শতাংশ মনে করেন, মেয়ে ও ছেলের সমাজে ও জীবনে সমান দক্ষতা দেখানোয় সমাজই নানা বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু অর্ধেকসংখ্যক উত্তরদাতার কাছে ‘স্বামীর অবাধ্য হলে স্ত্রীকে হালকা প্রহার’ গ্রহণযোগ্য।

উপলব্ধি ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রীয় নীতিতে বিশালাকারে দৃশ্যমান। দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে; একই সঙ্গে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা হয়েছে। নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে দ্বিধান্বিত। নারীর সম-অধিকার ও সমতার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নারীবৈষম্য নিরোধ কনভেনশনের ধারায় আপত্তি (reservation) প্রত্যাহার করতে বাংলাদেশ দ্বিধাগ্রস্ত ধর্মীয় কারণে, যদিও অধিকাংশ মুসলিম দেশ এই কনভেনশন গ্রহণ করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার সহায়-পুষ্ট মাদ্রাসা ও স্বাধীন (কওমি) ধারার প্রসার ঘটছে। সমান্তরাল মাদ্রাসাশিক্ষা ধারার প্রসার নিয়ে স্পষ্ট কৌশল, নীতি ও পরিণাম সম্পর্কে গণ-আলোচনা-পর্যালোচনায় একটা অনীহা বিরাজ করছে।

সামগ্রিক হতাশার প্রেক্ষাপটে আশার বার্তা হচ্ছে, শিক্ষকের সক্ষমতা, পেশাগত দক্ষতা, নৈতিক অবস্থানসহ ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে তাঁদের সম্ভাব্য ভূমিকা। গবেষণার উপসংহারে এবং সুপারিশে শিক্ষকের দায়িত্ব ও অবদানের কথা বারবার এসেছে, যদিও এই দায়িত্ব বর্তমানে যথার্থভাবে পালিত হচ্ছে না।
বর্তমানে ১০ লাখ মানুষ শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত এবং এই সংখ্যা আগামী এক দশকে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা। তাঁরা শ্রেণিকক্ষ ও এর বাইরে অসংখ্য শিশু-কিশোরের জীবনকে স্পর্শ করেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি পাঁচজনের একজনও দৃঢ়সংকল্প, সৎ প্রেরণা ও নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে যদি শিক্ষার্থীদের পথ দেখান, তাদের কাছে নিজেরা অনুকরণীয় মানুষ হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। তবে এ জন্য শিক্ষকের ভূমিকা, প্রস্তুতি, তাঁদের কৃতির মানদণ্ড এবং সমাজে তাঁদের মর্যাদা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

আরেকটি ইতিবাচক বার্তা হলো, মূল্যবোধ জরিপের সব ধরনের অংশগ্রহণকারী নৈতিকতা-মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়ার অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা সর্বাধিক মাত্রায় এই সংকল্প দেখিয়েছে। তাদের মূল্যবোধ বহালের কর্মোদ্যোগে সক্রিয় হওয়ার এই ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের নেতৃত্ব ও উদ্যম অপরিহার্য।

মনজুর আহমদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের সহসভাপতি