গত শতকের বাঙালি কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছিলেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’।
তিনি যখন এ কবিতাটি লেখেন, তখন মায়েদের কথা মনে রাখেননি। সে সময়ে মায়েরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। সে কারণেই কবি শিশুর অন্তরে কেবল শিশুর পিতাকে দেখেছেন, মাকে দেখেননি।
কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। সমাজ বদলেছে। এই শতকের কবিরা শিশুর অন্তরে কেবল পিতাকে দেখেন না, মাকেও দেখেন।
অর্থাৎ আমরা এই বাংলাদেশে, এই পৃথিবীতে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চাই, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সমান সুযোগ পাবে। সমমর্যাদায় গড়ে উঠবে। নারী বলে কেউ বৈষম্য বা বঞ্চিত হবে না। আফগানিস্তানের তালেবানদের মতো কেউ মেয়েদের স্কুলগুলো পুড়িয়ে দেবে না। সিরিয়ায় আইএসের মতো নারীর সমস্ত মানবিক মর্যাদা হরণ করবে না।
সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ করতে চায়, ২০৩১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ করার স্বপ্নও দেখেন কেউ কেউ। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে প্রথমেই প্রতিটি শিশুর অন্তরে মা-বাবা দুজনকেই দেখতে হবে। বাবারা সমাজে যেসব অধিকার পান, সবগুলো মায়েদের জন্যও নিশ্চিত করতে হবে। সেটি হতে হবে আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেত্রী নারী, স্পিকার নারী। তার পরও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনগুলো আমরা রহিত করতে পারিনি।
দুই
প্রতিবছর ১১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। অন্যান্য বছরের মতো এবারও নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই কর্মসূচি যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে বন্দী না থাকে। আমাদের প্রতিদিনের কাজে, কথায় ও আচরণে যেন আমরা কন্যাশিশু দিবসের গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করি। ছেলেশিশুদের সঙ্গে যেন তাদের কোনো ফারাক না করি।
এবারে কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কিশোরীর শক্তি: দৃশ্যকল্প ২০৩০’। আমরা যদি কন্যাশিশু তথা কিশোরীদের উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারি, তাহলে তারাও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। সমাজের উন্নয়নে, মানুষের উন্নয়নে সমভাবে অবদান রাখবে। নারীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়তে জাতিসংঘ উন্নতমানের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও অন্যান্য শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ন বা সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’নীতি গ্রহণ, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ও নারীর যৌন স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার কথা বলেছে। এর কোনোটির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
বাংলাদেশে কন্যাশিশু ও কিশোরীর জীবনমান উন্নয়নে অনেক অগ্রগতি আছে। কিন্তু এখনো অনেক পথ বাকি। সেটি কীভাবে পার হওয়া যাবে? প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি প্রায় শতভাগ এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণও আশাব্যঞ্জক, প্রায় ৬৯ শতাংশ (ব্যানবেইস ২০১৪), তবে ঝরে পড়ার হার এখনো বেশি—৪৭ শতাংশ (ব্যানবেইস)। আর্থসামাজিক সহায়তা ও সামর্থ্যের অভাবে তারা ঝরে পড়ছে। এখনো আর্থিক অসচ্ছলতা ও সামাজিক বাধার কারণে অনেক মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারছে না।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার একটি বড় কারণ বাল্যবিবাহ। ১৮ বছরের আগেই অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স হওয়া উচিত ছেলেদের সমান। ২১ বছর। কেননা, একটি মেয়ে কোনোভাবেই এর আগে উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারে না। লেখাপড়া শেষ না করে কোনো মেয়ে বিয়ে করলে আর্থিকভাবে পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়।
যেখানে বিয়ের ন্যূনতম বয়স বাড়ানো দরকার ছিল, সেখানে সরকার উল্টো বিয়ের বয়স কমানোর পাঁয়তারা করেছিল। এটি ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা উদাহরণ টানেন। কিন্তু তাঁরা চিন্তা করেন না যে পশ্চিমা দেশগুলোতে মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা, আর্থিক সামর্থ্য ও আইনি সুরক্ষা অনেক বেশি। এখানে মেয়েদের অধিকার রক্ষায় অনেক আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিকার চাইতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। কতগুলো সামাজিক সংস্কার তার টুঁটি চেপে ধরে। এখন রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
মনে রাখতে হবে, এখন আর শিশুর পিতা একা নন, শিশুর মাতারাও শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে আছেন। তাঁদের জাগানোর দায়িত্ব আমার, আপনার—সবার।