Thank you for trying Sticky AMP!!

সংসার টিকিয়ে রাখতে চাই দক্ষতা অর্জন

সম্প্রতি প্রথম আলোতে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে দেশে দিন দিন তালাকের হার বাড়ছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয় যে নারীরা অধিক হারে তালাকের আবেদন করছেন এবং ঢাকায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। প্রতিটি মানুষ জীবনে দুটি বিষয়কে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন—এক হচ্ছে তাঁর সন্তান ও দ্বিতীয় হচ্ছে তাঁর দাম্পত্যজীবন। আমরা সবাই চাই একটি নিরাপদ, সুখী, মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্যজীবন। প্রতিটি 

বিয়ের প্রাক্কালে সবার মনে এই প্রার্থনা থাকে, ‘আজীবন আমরা একত্রে থাকব’। কিন্তু সবার মনের এই আশা পূরণ হয় না।  

মনে রাখা ভালো, প্রেম বা বিয়ের প্রথম দিকের ‘ভালোবাসার উন্মাদনার’ উচ্ছ্বাস বড়জোর দুই বছর থাকে। তার মানে এই নয় যে ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে বা ভুল মানুষকে পছন্দ করেছি। ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থা নয়, এটি একটি কর্ম, জীবন দক্ষতা—যা প্রতিনিয়ত প্রদর্শন করতে হয় এবং চর্চা করতে হয়।

তালাকের অনেক কারণ রয়েছে। তবে তালাকের আবেদনে কাজিরা স্বামী বা স্ত্রী বা অভিভাবকদের কতগুলো গৎবাঁধা বুলি বা অভিযোগনামা বলে দেন সেখানে উল্লেখ করতে। গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তালাকের জন্য বহুবিধ কারণকে দায়ী করা হয়। তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে দাম্পত্যজীবনে দুজনের মধ্যে ‘কার্যকর পারস্পরিক যোগাযোগ ভেঙে পড়া’ এবং দাম্পত্যজীবনে ইতিবাচক ‘বিনিয়োগের’ অভাব ।

এ ছাড়া রয়েছে পরকীয়া প্রেম বা দাম্পত্যে অবিশ্বস্ততা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মাদকাসক্তি, যৌন সমস্যা, মূল্যবোধের বড় ধরনের অমিল, শ্বশুরপক্ষের লোকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, আর্থিক বা সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণে অবহেলা, যৌতুক-বিষয়ক জটিলতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ও অনৈতিক ব্যবহার, প্রতিশোধপ্রবণতা, বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছে নিরন্তর অপর পক্ষের বিরুদ্ধে বদনাম করে যাওয়া, সন্তানদের কায়দা করে নিজ পক্ষে নিয়ে অপর পক্ষকে জব্দ করার চেষ্টা, অযত্ন, অবহেলা, পরিত্যক্ত করে রাখা ইত্যাদি।

তবে যে ‘যোগাযোগ ঘাটতি বা বৈকল্যের’ কথা বলেছি, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্যে চার ধরনের যোগাযোগ-সমস্যা দেখা দিতে পারে—

১. আত্মসমর্পণ বা বিরোধিতা থেকে বিরত থাকা—তিক্ততার একপর্যায়ে এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে তারা আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে, সমঝোতায় আসতে চেষ্টাই করে না। তারা পারস্পরিক ঘৃণা, অবজ্ঞায় সব ধরনের যোগাযোগ এড়িয়ে চলে—ভাবখানা এমন, এসব নিয়ে আলোচনা বৃথা। ফলে তীব্র ক্ষোভ, বিরক্তি, অসন্তুষ্টি জমতে থাকে ও ধীরে ধীরে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে।

২. নিশ্চল বা নির্বাক হওয়া—এ ক্ষেত্রে তারা কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে ‘বিলম্বিত’ করার পন্থা নেয় বা স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের মধ্যে বরফাচ্ছাদিত একটি দেয়াল তৈরি হয়। তাদের মধ্যে দিন দিন উদ্বেগ বাড়তে থাকে।

৩. পালিয়ে বেড়ানো—নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা অন্য দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে নিজকে ব্যস্ত রাখতে চায়। এভাবে তারা একে অপর থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেউ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে, কেউ মাদকাসক্ত হয়, কেউ পর্নো দেখে, কেউ সারাক্ষণ কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবার কেউবা ‘কাজপাগল’ হয়ে সারাক্ষণ অফিস বা ব্যবসাস্থলে দিন গুজরান করে।

৪. সংঘাত, প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া—এটি হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের যোগাযোগ বিপর্যয়। এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা, বদনাম করতে থাকে; অনবরত অভিযোগ, নালিশ করতে থাকে; খুঁটিনাটি বিষয়েও সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে; তর্ক-বিবাদ তাদের দৈনন্দিন কাজ; এমনকি মৌখিকভাবে গালাগালি করে অপর পক্ষকে পরাস্ত করতে না পেরে হাতাহাতি ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। এ মারামারিতে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ‘ছাড়’ দিতে রাজি নয়—তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা যে করেই হোক ‘জিততে’ হবে।  প্রায় প্রতিদিন তাদের এ রকম খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে ও তাদের উভয়ের মধ্যে ‘ভয়ংকর’ সব প্রতিশোধস্পৃহা জাগতে থাকে (সেটি তালাক দেওয়া থেকে, মামলা, হামলা এমনকি খুনখারাবি কিংবা আত্মহত্যা)।

তবে এ রকম বেদনাদায়ক চিত্রের পাশাপাশি সুখী দাম্পত্যজীবনের উদাহরণও অসংখ্য রয়েছে। এঁরা তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই সুখী ও আনন্দিত সংসার জীবন যাপন করছেন। তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ, দুজনই জিতবে (উইন-উইন) তেমন একটি কার্যকর, গঠনমূলক যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।

যোগাযোগ একটি দক্ষতার ব্যাপার। তাই সবাই এটি অর্জন করতে পারে। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. সুসান হেইটলার তাঁর পাওয়ার অব টু বইয়ে লিখেছেন কীভাবে দাম্পত্য-সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় । তিনি দম্পতিদের তিনটি ‘এল’ দক্ষতা অর্জন করতে বলেন। সেগুলো হলো লিসেন, লাভ ও লার্ন।

লিসেন অর্থাৎ মনোযোগ দিয়ে শোনা। খুঁত, ত্রুটির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অপর পক্ষ কী বলতে চাচ্ছে, তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।  প্রথমে অন্য পক্ষের ক্ষোভ, অভিযোগ, নালিশ সহমর্মিতার সঙ্গে শুনতে হবে। পরে ঠান্ডা মাথায় ও সুকৌশলে ভিন্নমত থাকলে তা বুঝিয়ে বলতে হবে।

লাভ অর্থাৎ ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসাকে মাঝে মাঝে রিচার্জ করতে হয়, নবায়ন করে নিতে হয়। ভালোবাসা মানে সঙ্গীর প্রতি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি ছুড়ে দেওয়া। প্রতিদিন কিছু ইতিবাচক উষ্ণতা ছড়িয়ে দিন—সমর্থন, উৎসাহ প্রদান, ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, সেবাযত্ন, কোমল কণ্ঠে ভালোবাসার কথা বলা, জড়িয়ে ধরা। আমার চেম্বারে এক নারী রোগী স্বামীর বিরুদ্ধে অনুযোগ করে বলেন, ‘প্রতিদিন ভালোবাসলে কী হয়? প্রতিদিন আবেগ থাকলে ক্ষতি কী? এর জন্য তো কোনো টাকাপয়সা লাগে না স্যার।’

লার্ন অর্থাৎ শিখতে হবে। দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে হলে কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আমরা কেউ মায়ের পেট থেকে এগুলো শিখে আসি না। জীবন থেকে এগুলো শিখে নিতে হবে ও চর্চা করতে হবে। এগুলো নিজে ব্যবহার করে দেখুন অন্য পক্ষের আচরণে ও নাটকীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

পরিশেষে বলব, ‘হয় আমার পথে চলো, না হয় রাস্তা মাপো’—এ রকম মনোভাব পরিহার করে পারস্পরিক আনুগত্য মেনে নিলে দাম্পত্যজীবন হবে অনেক সহজ।  

মো. তাজুল ইসলাম অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
drtazul84@gmail.com