সফল হতে কী বই পড়ব
আত্ম-উন্নয়নমূলক বই বিক্রি বেশি হচ্ছে, এতে সাহিত্যের ক্ষতি হবে কি না! একজন সাংবাদিক বইমেলায় এ প্রশ্নও করলেন, এ ধরনের বই প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত কি না! আমার উত্তর ছিল, কোনো বই প্রকাশই সাহিত্যের ক্ষতি করতে পারে না। যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ, নিষেধাজ্ঞা শিল্পের জন্য, সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের বেশি করে সাহিত্য পড়া উচিত। আত্ম-উন্নয়নমূলক বই, যেমন সাফল্যের সহজ উপায়, কী করে আপনি ১৮০ দিনে কোটিপতি হতে পারেন, প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ—এ ধরনের বই পশ্চিমা দেশগুলোয় প্রচুর বের হয় এবং সেসব প্রচুর বিক্রিও হয়। যিনি সফল হওয়ার পরামর্শ দেন, অনেক সময় তিনি নিজে সফল নন (যেমন আমি), যিনি কোটিপতি হওয়ার পরামর্শ দেন, তাঁর হয়তো চুলায় হাঁড়ি ওঠে না। এ ধরনের বই পড়লে কোনো ক্ষতি আছে? উত্তর হলো, না ক্ষতি নেই।
কিন্তু যে কথা বলা খুব জরুরি তা হলো কেউ যদি সাহিত্য পাঠ না করেন, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান না পড়েন, তাহলে তা ক্ষতির কারণ হবে। সাহিত্য মানুষের মনকে সংবেদনশীল করে, অনুভূতিকে গাঢ় করে, আমরা একটা ঝরা পালকের জন্য কাঁদি, আমাদের কাছে ‘সুখহাসি আরও হবে উজ্জ্বল, সুন্দর হবে নয়নের জল, স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল আরও আপনার হবে।’
বিল গেটস প্রায়ই তাঁর পড়া ১০টা বই আর তাঁর দেখা ১০টা চলচ্চিত্রের তালিকা দেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল অনেক স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্ন তিনি পেয়েছিলেন বই থেকে। তিনি এক লেখায় তাঁর স্কুলের লাইব্রেরিয়ানের কথা বলেছিলেন, যিনি তাঁকে বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। মিসেস ক্যাফিএয়ার নামের ওই শিক্ষিকার অবদান তিনি তাঁর মা আর নানির সঙ্গেই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
সফল হওয়ার জন্য পরিশ্রম আর অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯-এর বিশ্বকাপ জয়ের উদাহরণটি একটু বিশ্লেষণ করি, দেখব, সেই পুরোনো সূত্রই কাজে লেগেছে। দুই বছর আগে কুড়িজনের দল ঠিক করা হয়েছে। দেড় বছর আঠারো জনের দলটি একসঙ্গে থেকেছে, খেয়েছে, খেলেছে। তারা কঠোর পরিশ্রম করেছে। তাদের কোচ তাদের খেলার অনুশীলন করিয়েছেন, কঠোর ফিটনেস করিয়েছেন ফিজিও। তারা জিততে চেয়েছে, তাদের মধ্যে কাজ করেছে জিগীষা।
আমাদের স্মরণে আসবে, জার্মানি যেবার ব্রাজিলে গিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল জিতল, সেবার তারা ব্রাজিলে দ্বীপ ভাড়া করে সেখানে অনেক দিন ধরে একসঙ্গে থেকে অনুশীলন করেছে। শ্রীলঙ্কা যেবার বিশ্ব ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তারা একই টিম একসঙ্গে অনেকগুলো ম্যাচ খেলেছিল। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দল যে ভালো করে, তার কারণও তারা প্রাথমিক স্কুল থেকে ফুটবল খেলা শুরু করেছে, তারপর তাদের ঢাকায় ক্যাম্পে রেখে দেওয়া হয়, তারা একসঙ্গে থাকে, আর ক্রমাগত অনুশীলন করে।
দ্য স্টোরি অব সাকসেস (সাফল্যের গল্প) নামের একটা ভুবনবিখ্যাত বই আছে, ম্যালকম গ্লাডওয়েলের লেখা। সেখানে তিনি বলেছেন, যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত দক্ষতা অর্জন করতে হলে সেই বিষয়ে ১০ হাজার ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হবে। মানে মোটামুটি চার বছর দিনে আট ঘণ্টা করে ওই একটা বিষয় নিয়ে অনুশীলন করতে হবে।
এ কথা মোটামুটিভাবে সত্য। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া সারা বাংলাদেশের কুড়ি লাখ ছেলেমেয়ের মধ্যে যারা ক্রিকেট ভালো খেলছে, এ রকম ৫০০ জনকে বাছাই করে যদি চার বছর সপ্তাহে ছয় দিন রোজ আট ঘণ্টা করে ভালো কোচের অধীনে ক্রিকেট খেলানো যায়, এরা যখন ক্লাস টেন পাস করে বেরোবে, তখন তাদের ভেতর থেকে দেশসেরা ২২ জন খেলোয়াড় আমরা পাব। ব্যতিক্রম হবে, ৫০০ জনই ভালো ক্রিকেটার হবে না। আবার দেশের সেরা ২২ জনের মধ্যে এর বাইরে থেকেও খেলোয়াড় আসবে।
ম্যালকমের এ ১০ হাজার ঘণ্টা তত্ত্বের ওপর অনেক গবেষণা হয়েছে, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণা করেছে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এ তত্ত্ব মোটের ওপর সত্য নয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে এটার সত্যতা মাত্র ১ ভাগ।
১০ হাজার ঘণ্টার তত্ত্ব যে অভ্রান্ত নয়, তা বুঝতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় লাগে না। একটা আমগাছে ১০ হাজার দিন চেষ্টা করলেও কাঁঠাল ফলাতে পারবে না। কিন্তু দুটো কথা থেকে আমি সরছি না। ১. জীবনে বড় হয়েছেন, সফল হয়েছেন, কিন্তু পরিশ্রম করেননি, লেগে থাকেননি, এ রকম উদাহরণ একটাও পাওয়া যাবে না। ২. বড় ব্যবসায়ী হওয়া, বড় ব্যাংকার হওয়া, সিইও হওয়া, বড় গায়ক বা লেখক হওয়াই আসল কথা নয়। আসল কথা হলো ভালো মানুষ হওয়া। যদি কেউ বই না পড়েন, গান না শোনেন, ভালো চলচ্চিত্র না দেখেন এবং তার যদি নৈতিকতার শিক্ষা না থাকে, মূল্যবোধ না থাকে, তাহলে তিনি খুব ক্ষতিকর একজন মানুষ হবেন। তিনি বন ধ্বংস করতে পারেন, নদীকে হত্যা করতে পারেন, ট্রাম্পের মতো বলতে পারেন, জলবায়ু পরিবর্তন আসলে গুল-গাপ্পি, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ ধরনের সফল মানুষেরা পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারেন।
জীবনে কেউ ব্যর্থ হয় না। প্রতিটি মানুষই সফল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে জোনাকিকে বলেছেন, ‘তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ! তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ।’ জোনাকি চাঁদ-সূর্যের মতো বড় হতে না পারে, কিন্তু সে তো আলো জ্বালে। আমরা যে যা-ই করি না কেন, আমরা যেন ভালো কাজ করি, আমরা যেন আলো জ্বালি।
বেগম রোকেয়া স্কুলের ছাত্রীদের উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছিলেন, তোমরা যে স্কুলভবন দেখছ, তা গড়তে অনেক মাটিকে নিজেকে পুড়িয়ে ইট হতে হয়েছে, অনেক শামুককে নিজেকে পুড়িয়ে চুন হতে হয়েছে, অনেক গাছকে করাতকে বুকে টেনে নিয়ে নিজেকে চিরে কাঠ হতে হয়েছে। কষ্ট করা ছাড়া, সাধনা করা ছাড়া কেউ সফল হয়নি। আর সাফল্য মানে কেবল ধনবান হওয়া কিংবা খ্যাতিমান হওয়া নয়, মানুষের উপকারে আসা।
সাফল্যের সহজ কোনো সূত্র নেই। কঠোর পরিশ্রম লাগবেই। কিন্তু শুধু মোটিভেশনাল বই পড়লে চলবে না, সাহিত্য পড়তে হবে। সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। সামাজিক কাজে অংশ নিতে হবে।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক