Thank you for trying Sticky AMP!!

সেরা ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালের কথা বলি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছেন শেখ কামাল। সেটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ জন্মদিন পালন। ১৭ মার্চ, ১৯৭৫।

ছবি তুলতে গিয়েই ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট মাঠে প্রথম দেখি শেখ কামালকে। সাদা সার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা এক যুবক হাতে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে নামছেন। সে সময় জ্যেষ্ঠ ফটোগ্রাফারদের মধ্যে টেলিলেন্স ব্যবহারে কোনো প্রচলন ছিল না। থাকবে কী করে, সবার হাতেই যে ১২০ মিলিমিটারের বক্স ক্যামেরা। খেলোয়াড়দের কেউ ৫০ কিংবা ১০০ রান হাঁকালে আম্পায়ারদের অনুমতি নিয়ে এক দৌড়ে ক্রিজে গিয়ে ছবি তুলতে হতো প্রেস ফটোগ্রাফারদের। ১৯৭৩ সালে এমন এক ব্যাটসম্যান ছিলেন শেখ কামাল। সেই আমার প্রথম বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের ছবি তোলা।

কাছে থেকে প্রথম দেখায় শেখ কামাল ব্যবহার আমাকে উৎফুল্ল করে। একেবারেই সাধারণ ২৩ বছরের এক যুবক যেমন, তেমনই তিনি। শরীরের চেয়ে বড় এক জোড়া গোঁফ। সেই গোঁফের নিচে অমলিন এক টুকরো হাসি, সব সময় লেগেই আছে ঠোঁটজুড়ে। অন্য সবার চেয়ে কনিষ্ঠ বলে আমার ক্যামেরায় একটু যেন সেই দিন বেশি বেশি ব্যাট উঁচিয়ে পোজ দিলেন তিনি।

সেই ভালো লাগা মানুষটার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয় আকস্মিকভাবেই ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়িতে, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার এক ফাঁকে নিচতলায় গাড়িবারান্দায় আসতেই দেখা হয়ে গেল শেখ কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। আমাকে দেখেই কামাল ভাই জন্মদিনের কেক আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘কেমন আছ?’ এত আপন করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যেন কত দিনের পরিচয় আমাদের। ‘কোথায় কাজ করো তুমি? তুমি কি আমাদের আবাহনীর ছবি তুলে দেবে?’ প্রথম সাক্ষাতেই শেখ কামালের এমন অনুরোধে আমি বিস্মিত হয়ে যাই! বললেন, ‘আবাহনী ক্লাব কোথায়, তুমি চেনো?’ সন্ধ্যায় চলে এসো ক্লাবে। আমরা গণভবনে যাব বঙ্গবন্ধুকে আবাহনীর পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে!’

আবাহনী ক্লাব থেকে দল বেঁধে গেলাম আমরা গণভবনে। গণভবনের সবুজ লনে আবাহনীর খেলোয়াড় আর অফিশিয়ালদের প্রতীক্ষায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জন্মদিনের সন্ধ্যায় তিনি আমাদের আসতে দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কামাল ভাই তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে প্রথম অভিনন্দন জানালেন। সন্ধ্যায় গণভবনে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনে! আমার ক্যামেরায় সেই সন্ধ্যার দারুণ সব ছবি তুলছি। কামাল ভাই সেই সন্ধ্যায় পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।

কামাল ভাইয়ের সুন্দর একটা মন ছিল। যে মনে অঙ্কুরিত হতো নিত্যনতুন ভাবনা। আর সেই ভাবনায় আমরা সংগঠিত হয়েছি আবাহনীতে, নাট্যচক্রে, ঢাকা থিয়েটারে, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী, মহান একুশের শ্রদ্ধায় কিংবা নবান্ন নাটকের মঞ্চে।

স্বাধীন দেশে সীমিত সুযোগের মধ্যে কামাল ভাই আবাহনীর মতো ক্রীড়া সংগঠন গড়ে তোলেন। বলা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে তিন বছরে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্রীড়া আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীরবে যে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল, তার পুরো পরিকল্পনা ছিলেন শেখ কামাল ভাইয়ের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন কৃতী ছাত্র হিসেবে যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জাগরণের কথা ভেবেই শুরু করেছিলেন নানা সংগঠন। বিশেষ করে আবাহনী ক্রীড়া চক্র বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে তিনি। ফুটবলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বছর চ্যাম্পিয়নের মাধ্যমে তিনি ইতিহাস রচনা করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, ভলিবল, সেই সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে এলেন ক্রীড়াক্ষেত্রে।

গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে আবাহনীর পতাকাতলে সব ক্রীড়া অনুরাগীকে একত্র করতে চাইলেন এবং সে লক্ষ্যে প্রথম শাখা খুলেছিলেন ফরিদপুরে। সেই উদ্যোগে শামিল হতে আমরা চলেছি ফরিদপুর। পদ্মা নদী পারাপারের জন্য বিশেষ ফেরি তখনো ভেড়েনি ঘাটে। এরই ফাঁকে আরিচা ঘাটে খবর ছড়িয়েছে, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল এসেছেন। ক্ষুদ্র ফেরিওয়ালাদের ভিড় পড়ে গেল তখন। কলাওয়ালা, ডাবওয়ালা ছুটে এলেন।

বিশেষ ফেরিটি আমাদের মাত্র কটা গাড়ি নিয়েই ভেসে চলল পদ্মায়। কিছু পরে ব্যাপারটি কামাল ভাইয়ের চোখে পড়ল। তিনি ফেরিকে তাৎক্ষণিক ঘাটে ভিড়তে বললেন, আর অপেক্ষমাণ যাত্রীদের গাড়ি, বাসসহ যে কটা প্রাইভেট ট্যাক্সি, সব তুলে নিতে বললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বাসসহ অন্য গাড়ির যাত্রীরা শেখ কামালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। ফরিদপুরে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের শাখা উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে সারা দেশে জনপ্রিয় এই ক্লাব খোলা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন কামাল ভাই।

স্বাধীন দেশে সীমিত সুযোগের মধ্যে কামাল ভাই আবাহনীর মতো ক্রীড়া সংগঠন গড়ে তোলেন। বলা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে তিন বছরে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্রীড়া আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীরবে যে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল, তার পুরো পরিকল্পনা ছিলেন শেখ কামাল ভাইয়ের।

মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী শেখ কামাল শুধু ক্রীড়াতেই সাফল্য আনেননি, তিনি ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন অনুরাগী শিক্ষার্থী, ছায়ানটের ছাত্র। সেতারে ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে ধানমন্ডির বাড়িতে তালিম নিলেও পিয়ানোর প্রতিও তাঁর দারুণ আগ্রহ ছিল। তাঁর তিনতলার ঘরে ছিল বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। ৩১ নম্বরের তিনতলায় সকালে ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়ার পর তিনি তাঁর প্রিয় নীল টয়োটায় ছুটতেন শংকরের আবাহনী ক্লাবে। সেখান থেকে ধানমন্ডির আবাহনীর প্র্যাকটিস ফিল্ডে। কখনো কখনো সাতসকালে কামাল ভাইয়ের সঙ্গী হতাম আমি ৩২ নম্বরে। আবাহনীর খেলোয়াড়দের সঙ্গে কামাল ভাই অংশ নিতেন ফুটবল খেলায়। খেলোয়াড়দের সকালের নাশতা, দুপুরের আর রাতের খাবার, সবকিছুতেই তিনি তদারক করতেন একটি যোগ টিম গড়ে তোলার লক্ষ্যে। বাস্কেট বল খেলোয়াড় হিসেবে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কামাল ভাই নিজে একজন পারদর্শী ক্রিকেট খেলোয়াড়ও ছিলেন।

সহপাঠী থেকে শিক্ষক, ছোট-বড় সবাইকে সম্মান করতেন শেখ কামাল। প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের পুত্রের কোনো অহমিকা তাঁর মধ্যে ছিল না। নিজে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’খ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পারিবারিক পছন্দে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। দুই পরিবারের গুরুজনদের নিয়ে ‘কনে’ দেখার আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ের এক সন্ধ্যায়।

শেখ কামাল ভাই মানুষ এবং তাঁর কাজকে সম্মান করতেন। আজিমপুর মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে গেল কামাল ভাইয়ের নীল টয়োটা। আমাকে আজিমপুর কলোনির বাসায় ড্রপ করতে আসছিলেন কামাল ভাই। সহযাত্রী কেউ একজন গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশের উদ্দেশে বলে বসলেন, ‘এটা শেখ কামালের গাড়ি।’ কিন্তু সার্জেন্ট সে কথা আমলে নিলেন না। তিনি গাড়ি চেক করবেন। সঙ্গে সঙ্গে কামাল ভাই নিজে গাড়ি থেকে নেমে আমাদেরও নামতে নির্দেশ করলেন। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। পুরো গাড়ি চেক করলেন পুলিশ সার্জেন্ট। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেননি সেই রাতে। এমনকি পুলিশ সার্জেন্টকে তাঁর ডিউটির প্রশংসা করলেন। এমনই ছিলেন কামাল ভাই!

আজ শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাইয়ের ৭২তম জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করছি। তিনি বেঁচে থাকলে ক্রীড়া অঙ্গন কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর নেতৃত্বে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ গৌরবের উচ্চ আসনে অবস্থান করত! এমন প্রতিভার অধিকারী শেখ কামাল নিজ দায়িত্বের বোধের প্রমাণ করেছেন নিজেকে বিলিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি প্রথম ছুটে নেমেছিলেন তিনতলায় নববিবাহিত স্ত্রীকে রেখে। উপস্থিত সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন চিরায়ত তাঁর ব্যবহারের মাধ্যমে, ‘পুলিশ ভাইয়েরা, আর্মি ভাইয়েরা, এত গুলি চলছে, আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

নিজের পিতাই শুধু নয়, জাতির জনক দেশের প্রেসিডেন্টকে ও তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল! তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

পাভেল রহমান আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাকালীন আলোকচিত্রী