Thank you for trying Sticky AMP!!

হারজেল ও ইসরায়েল রাষ্ট্র: ফিলিস্তিনের অশেষ যন্ত্রণা

থিয়োডর হারজেল: যার স্বপ্নের বাস্তবায়নই হলো আজকের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল

‘ব্যাসেলে আমি ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করেছি। যদি আমি এটা এখন প্রকাশ্যে বলি, তাহলে আমি হয়তো দুনিয়াজুড়ে হাসির খোরাক হব। তবে সম্ভবত ৫ বছরের মধ্যে এবং নিশ্চিতভাবে ৫০ বছরের মধ্যে সবাই এটা দেখতে পাবে।’

অস্ট্রিয়ার ইহুদি সাংবাদিক, নাট্যকার ও রাজনীতিক থিয়োডর হারজেল তাঁর ডায়েরিতে ১৮৯৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এসব কথা লিখেছিলেন। এর সপ্তাহখানেক আগে সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাসেল নগরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইহুদিবাদী সম্মেলন (ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট কংগ্রেস)। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে শুধু ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা গৃহীত হয়। হারজেলই ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা। তার আগের বছর, মানে ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর লেখা পুস্তিকা ইহুদি রাষ্ট্র (দ্য জিউইশ স্টেট) প্রকাশিত হয় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে।

হারজেল ও তাঁর সহযোগীরা মনে করতেন যে ইহুদিবিদ্বেষ ঠেকানোর রাজনৈতিক সমাধান হলো একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র। সে উদ্দেশ্যেই আজ থেকে ১২৫ বছর আগে ব্যাসেলে ইহুদিবাদীদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের পর হারজেলের নিজ ডায়েরিতে লেখা ভবিষ্যদ্বাণী যে বাস্তবে ফলে যাবে, তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ১৯০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে ওই সম্মেলনের ৫১ বছর পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল আত্মপ্রকাশ করে।

ফিলিস্তিনের ভূমিকেই ঠিক করা হয় ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য। হিব্রু বাইবেলের সূত্র ধরে দাবি তোলা হয়, এটাই ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি (প্রমিজড ল্যান্ড), যেখান থেকে তারা একসময় বিতাড়িত হয়েছিল। কাজেই সেখানে ফিরে যাওয়া তাদের ন্যায্য ও বৈধ অধিকার।

Also Read: শিরিন আবু আকলেহ: নিপীড়িত ফিলিস্তিনি স্বর স্তব্ধ হয়ে গেল

দুই.

এ বছর ২৯ আগস্ট উদ্‌যাপিত হবে ব্যাসেল সম্মেলনের ১২৫ বছর পূর্তি। এ নিয়ে ইসরায়েলে ও সুইজারল্যান্ডে প্রস্তুতি চলছে। ইহুদিবাদের পিতা হিসেবে থিয়োডর হারজেলকে বিশেষভাবে তুলে ধরা ও সম্মানিত করার আয়োজন রাখা হয়েছে। যদিও হারজেলই প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি শুধু ইহুদিদের জন্য পৃথক একটি দেশগড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে তিনি এই ইচ্ছাকে একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, যেটি মোটাদাগে ইহুদিবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পায়।

ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরের আরেক নাম জায়নকে বেছে নেওয়া হয় ইহুদিদের বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতিকে সংবেদনশীল করে তোলার জন্য। ফিলিস্তিনের ভূমিকেই ঠিক করা হয় ইহুদিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য। হিব্রু বাইবেলের সূত্র ধরে দাবি তোলা হয়, এটাই ইহুদিদের জন্য ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি (প্রমিজড ল্যান্ড), যেখান থেকে তারা একসময় বিতাড়িত হয়েছিল। কাজেই সেখানে ফিরে যাওয়া তাদের ন্যায্য ও বৈধ অধিকার।

এই অধিকার আদায়ের জন্য শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। ইউরোপের ধনাঢ্য ইহুদিরা অর্থকড়ি ঢালতে থাকে তৎকালীন প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য। ধর্মবিশ্বাস আর পুরাকথার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্যের মিশেল ঘটিয়ে জোর প্রচারণার মাধ্যমে পশ্চিমাজগতে এই স্বীকৃতি আদায় করা হয় যে ‘ভূমিহীন একদল মানুষের জন্য মনুষ্যহীন একটি ভূমি’ আছে, আর তা হলো ফিলিস্তিনের ভূমি। হারজেল অবশ্য ১৮৯৬ সালে ইস্তাম্বুলে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেরেছিলেন যে জেরুজালেমসহ অটোমান-ফিলিস্তিনের কিছু অংশ ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ দিতে। বিনিময়ে ঋণগ্রস্ত সুলতানকে এখনকার বাজারদরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার দিতেও চেয়েছিলেন। সুলতান তা প্রত্যাখ্যান করেন।

বস্তুত, প্রাচ্যের ইহুদিদের দিক থেকে, যারা মিজরাহি নামে পরিচিত, কোনো স্বতন্ত্র ইহুদি আবাসভূমির তাগিদ তাদের ছিল না; বরং ১৪৯২ সালে স্পেনের ইহুদিদের রক্ষার জন্য উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ জাহাজ পাঠিয়ে তাদের নিয়ে এসেছিলেন, যারা সেফারদিক নামেও পরিচিত। ইউরোপ ও রাশিয়ায় বসবাসরত ইহুদিরা বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, আর হচ্ছিল প্রধানত খ্রিষ্টানদের হাতে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার নাম করে ফিলিস্তিনে একটি ইউরোপীয়-ইহুদি উপনিবেশ গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। সেটাকে ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও ইহুদিবিদ্বেষী ইউরোপীয়রা সমভাবে সমর্থন দেয়। কেননা, তারা এটাকে ইহুদি সমস্যা থেকে ইউরোপের মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছিল। অন্যদিকে এটা ছিল মূলত আশকেনাজি ইহুদি পরিচালিত আন্দোলন।

Also Read: ফ্রিল্যান্সিংয়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

তিন.

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ধর্মের ভিত্তিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হলেও পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কাছে এটা কোনো সমস্যা নয়। কেননা, ইহুদিরা অন্য সবার থেকে শুধু ধর্মের ভিত্তিতেই পৃথক নয়, তারা একটি পৃথক জাতিসত্তা, পৃথক বর্ণ ও গোত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ—এ রকমটাই দাবি ইহুদিদের। হিটলারের নাৎসিবাদও অনেকটা একইভাবে জার্মানদের আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছে। এই দাবিকে টেকাতে হলে ইহুদিদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নাকচ করতে হয়! আর তা করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নৃশংস নিধনযজ্ঞের শিকার হয় ৬০ লাখ ইহুদি, যা ইতিহাসের হলোকাস্ট হিসেবে পরিচিত। আবার এই হলোকাস্টই ইহুদিদের নিজস্ব দেশের দাবি ও প্রয়োজনীয়তা জোরদার করে তোলে।

চার.

উসমানীয় সুলতানের সঙ্গে দেনদরবার ব্যর্থ হওয়ায় হারজেল ও তাঁর সঙ্গীরা ব্রিটিশ সরকারের দিকে ঝোঁকেন। এদিকে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের খেলায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হতেই ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর ইহুদিবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটেনের সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। ইতিহাসে যেটি ব্যালফোর ঘোষণা হিসেবে খ্যাত। এটি অবশ্যই ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এরপর ১৯২০ সালে ইতালির সান রেমো শহরে ভেঙে পড়া উসমানীয় সাম্রাজ্য ভাগবাঁটোয়ায় ফিলিস্তিন ও ইরাক শাসনের ম্যান্ডেট পায় ব্রিটেন, যার বৈধতা দেয় লিগ অব ন্যাশনস।

১৯৪৭ সালে নবগঠিত জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দুই ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে। আরব বিশ্ব এটি প্রত্যাখ্যান করলেও প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা ছিল না তাদের। বরং হারজেলের পূর্বাভাস সত্যি ও ব্যালফোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনে তাদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটায়, ইহুদিবাদীরা ঘোষণা দেয় স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের। এর পরই শুরু হয় ফিলিস্তিনদের বিতাড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন। সাত লাখ ফিলিস্তিনি, ইহুদি আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালাতে থাকে। যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ মে, যা আল-নাকবা বা বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত।

পাঁচ.

সেই নাকবার ৭৪ বছর পূর্ণ হলো আজ। এর মধ্যে তিনটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরব দেশগুলোর পরাজয় ও ব্যর্থতাই বেড়েছে। তাই ফিলিস্তিন আজও ইসরায়েলের দখলদারিতে। ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড সংকুচিত হয়ে গেছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা আর জর্ডানের পশ্চিম তীরে। তাদের জীবন-জীবিকা নিত্য নিষ্পেষিত হয় ইসরায়েলের খামখেয়ালিতে। আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম উদ্বাস্তু আর শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে লাখো ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানও জটিল এবং সুদূরপরাহত হয়ে পড়েছে। হয়তো আরও দুই যুগ পেরিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্‌যাপন করবে, তখন হয়তো ফিলিস্তিন নামটা থাকবে ইতিহাসের পাতায়, সংকুচিত হতে থাকা ভূখণ্ড মানচিত্র থেকে মিলিয়েই যাবে। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ হত্যাকাণ্ড কি সে রকম একটি আভাসই দিয়ে গেল?

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com