'উপাচার্য ভ্যাকেশন' এবং আমরা কেমন শিক্ষক

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আন্দোলন দমানোর নামে অতীতে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখা হতো। জবরদখল করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জেনারেল এরশাদ প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থবিনাশী এ ভ্যাকেশনগুলোকে অনেকে এরশাদ ভ্যাকেশন হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজকের যে শিক্ষা-সংকট, তার অনেক শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে এরশাদ ভ্যাকেশনের মধ্যে।

এরশাদ একজন স্বৈরশাসক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের সমস্যা, ভালো-মন্দের চেয়ে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিজের ক্ষমতা পোক্ত করা। এরশাদ সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিলেন এবং তার বিনিময়ে ৯ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। এরশাদ ভ্যাকেশনের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তখন নৈতিকভাবে এরশাদবিরোধী এবং প্রচণ্ড শিক্ষার্থীবান্ধব ছিলেন। হঠাৎ হল ভ্যাকেট হলে শিক্ষার্থীদের দুর্দশা লাঘবে শিক্ষকেরা তাঁদের খাবার দিতেন, টাকাপয়সা দিতেন এমনকি কখনো কখনো নিজ গৃহে অবস্থান করার সুযোগ করে দিতেন।

এরশাদ নেই কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ পাওয়া একেকজন উপাচার্য আজ একেকজন আঞ্চলিক জমিদার। পাইক-পেয়াদা নিয়ে তাঁরা একচেটিয়া শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর চাপে-তাপে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন বিদ্যমান। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ‘দেশের প্রায় দেড় ডজন (১৭টি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের লিখিত অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়োগ-বাণিজ্য, অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি-পদায়ন, অর্থ আত্মসাৎ, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম।’

এ রকম এক পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস আগে বিতর্কিত ‘উন্নয়ন প্রকল্পকে’ ঘিরে আন্দোলন শুরু হয়, যা বর্তমানে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। আন্দোলনের একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করলে ছাত্রলীগ ‘হামলা’ করে। অবরুদ্ধ উপাচার্য এ জন্য ছাত্রলীগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং এ দিনের ঘটনাকে তিনি তাঁর জীবনের অত্যন্ত আনন্দের দিন হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু সে আনন্দ টেকসই হয়নি। পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করে যে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। উপাচার্য হিসেবে নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা এর আগে কোথাও ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা উপাচার্যের বদৌলতে একটি বন্ধ পেয়েছি যাকে ‘উপাচার্য ভ্যাকেশন’ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

যে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা অবাঞ্ছিত। কর্তৃপক্ষ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ করতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলতে হলগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এবং আশপাশে দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চলাফেরা ও খাবারের মতো মৌলিক অধিকার ও চাহিদা হরণ করে নেওয়া হয়েছে।

উপাচার্যপন্থী শিক্ষক যাঁরা গত মঙ্গলবারের ‘হামলাকে’ ‘ধর ধর, মার মার’ বলে সমর্থন করেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বারবার বলছেন যে তাঁরা অবরোধ তুলে দিতে চেয়েছেন, কারণ তাঁরা চান নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা অব্যাহত থাকুক। যে শিক্ষকেরা বারবার ক্লাস-পরীক্ষা অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকে সমর্থন করেছেন, নিজের সহকর্মীকে আক্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন; তাঁরাই আবার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করেছেন। এতে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা সম্ভবত তাঁরা এখন আর স্মরণ করতে পারছেন না।

সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কেমন শিক্ষক? এটা কি কল্পনা করা যায় যে আপনি একজন শিক্ষক এবং আপনার একজন নারী শিক্ষার্থীকে পেটে লাথি মেরে আহত করা হয়েছে, অথচ আপনার কোনো বিকার নেই। এটা কি কল্পনা করা যায়, আপনার শিক্ষার্থীদের আপনারা সন্ধ্যার সময় হল থেকে বের করে বিপদে ফেলে দিয়েছেন? এবং তা কোনো চাপে পড়ে নয়, নিজেদের স্বার্থে। আমরা কেমন শিক্ষক যে নিজেদের স্বার্থে এমনকি হিন্দু ছাত্রদেরও ‘শিবির কর্মী’ হিসেবে চালিয়ে দিই? এটা কি কল্পনা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গুণী সহকর্মী ছাত্রদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন আর উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা বলছেন, ‘ধর ধর, মার মার’!

সভা-সমাবেশ-মিছিল রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অধিকার। অনুরূপভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির দায়িত্ব হচ্ছে উপাচার্যসহ সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দান। কিন্তু আমরা কেমন শিক্ষক যে উপাচার্যের পাহারায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করি? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশক ধরে বিভিন্ন উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে লক্ষ করা যায়, একদল শিক্ষক উপাচার্যের পথ অবরুদ্ধ করে রাখছেন, আরেক দল উপাচার্যের পাহারায় নিজেদেরকে নিযুক্ত করে রাখছেন। এক দল আন্দোলন করছে, অন্য দল উপাচার্যের পক্ষে মানববন্ধন করছে। এটা কেমন শিক্ষকতা?

কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা তাঁদের নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিত হয়ে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যতটা না উন্নয়নের ব্যাপারে আগ্রহী, শিক্ষার ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। ফলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এ ধরনের প্রশাসন টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়োগ দিতে হয় মেরুদণ্ডহীন অযোগ্য শিক্ষক। শিক্ষকতা অনেকটাই রূপ নিয়েছে দলীয় তল্পিবাহকের ভূমিকায়। উপাচার্য ও শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন তা বোঝা যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি আঁকা একটি গ্রাফিতিতে—যেখানে দেখানো হয়েছে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত উপাচার্যের পায়ের কাছে পড়ে আছেন চাটুকার শিক্ষকেরা।

শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঁচাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির সংস্কৃতি বদলাতে হবে। এমন উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে, যিনি উন্নয়ন বলতে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবেন। যিনি সারা দিন সারা রাত অনুগতদের তোষামোদের বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মনোনিবেশ করবেন। অন্যথায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থের অপচয় ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে কোনো অবদান রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।

মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক।
mozahid@juniv.edu