মতামত

রাজনৈতিক মেরুকরণ পরিষ্কার হচ্ছে

জুলাই ’২৪ বিপ্লবের পর রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছিল বিপ্লবের ছাত্রনেতাদের কার্যক্রম ঘিরে। বিপ্লবী ছাত্রনেতারা দুইভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এক, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে; দুই, নাগরিক কমিটি করে পরীক্ষামূলকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে। দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই দুই ভাগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।  

এই তাল মেলানোটা একতরফা ছিল না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও অন্যান্য দলের, বিশেষ করে বড় দল বিএনপির সমালোচনাকে আমল দিয়ে তাদের বিভিন্ন সময়সূচি পরিবর্তন করতে হয়েছে।

প্রথমে বিভিন্ন উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, যত সব সংস্কার তাঁরা দরকার মনে করেন, সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার আগে তাঁরা নির্বাচন সমর্থন করবেন না। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু বড় দলগুলোর অধৈর্য টের পেয়ে সরকার সম্ভবত সেই অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে। এ বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের মার্চের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি কখনো অস্থায়ী সরকারকে সমালোচনা, কখনোবা সমর্থন জানিয়ে অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে একটা স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে।

প্রথমে তারেক রহমান চাইছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে বা তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে জাতীয় সরকার বা নতুন নির্বাচনের একটা পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ করতে। বিএনপি এরই মধ্যে আ স ম আবদুর রব, নুরুল হক নুরু, জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের কিছু নেতার জন্য নির্বাচনী সমঝোতামূলক আসন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করেছে।  কিন্তু বৈষম্যবিরোধীরা এ ধরনের সমঝোতায় আগ্রহী বলে মনে হয় না। তারা এরই মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।

জামায়াতে ইসলামী প্রথম থেকেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করার কাজে চেষ্টা শুরু করে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তাদেরকে কিছুটা বিএনপির ছায়ায় থেকে রাজনীতি করতে হয়েছে।

৫ আগস্টের পর জামায়েত গা ঝাড়া দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার ঘোষণা দেয়। বিএনপিও জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছে। জামায়াতের অনেক কথাবার্তা বিএনপির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, এই ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরে কিসের নির্বাচন হবে? জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন? আর জাতীয় নির্বাচন হলে সেটা কি  সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ গঠন করার জন্য নির্বাচন? নাকি নতুন পার্লামেন্ট গঠন করার নির্বাচন? নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টি খোলাখুলি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের বেশ কিছু নেতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিলেন। মাঝেমধ্যে কিছু মতান্তর হলেও সেই ঐক্য মোটামুটি অক্ষুণ্ন রয়েছে। এটাকে জামায়াত খুব ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তাঁরা নির্বাচনের জন্য সরকারকে আরও সময় দিতে প্রস্তুত আছে। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত ভিন্ন ও বলা যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থান নিয়েছে।

অন্য ছোট দলগুলোর মধ্যে নুরুল হক নুরুর গণ অধিকার পরিষদ ও জোনায়েদ সাকির গণশক্তি পরিষদের তরুণদের মধ্যে কিছু সমর্থক রয়েছেন। ডাকসুর ভিপি থাকাকালে নুরুল হক নুরুই প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, নুরুল হক সম্ভবত এখন বিএনপি জোটে থেকেই পর্যবেক্ষণ করবেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত অন্য রকম হতে পারে।

২৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুন রাজনৈতিক দল—জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তিনি অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। নতুন দল ঘোষণার সময় নাহিদ বলেন, এই দল ভারত ও পাকিস্তানকে তোষণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করবে। এর আগে ছাত্রনেতারা পরিবারভিত্তিক রাজনীতির সমালোচনা করেন। এসব থেকে আঁচ করা যায়, পরবর্তী রাজনৈতিক বিতর্ক কী নিয়ে শুরু হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হওয়ার আগে থেকেই বিএনপি এই প্রক্রিয়াকে ‘কিংস পার্টি’ আখ্যায়িত করেছে; কিন্তু তকমা তাদের গায়েও মেখে আছে।
ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে আসা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে রয়ে গেছেন। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির লিয়াজোঁ হিসেবে গণ্য করলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।  

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, এই ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ডিসেম্বরে কিসের নির্বাচন হবে? জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় নির্বাচন? আর জাতীয় নির্বাচন হলে সেটা কি  সংবিধান লেখার জন্য গণপরিষদ গঠন করার জন্য নির্বাচন? নাকি নতুন পার্লামেন্ট গঠন করার নির্বাচন? নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টি খোলাখুলি ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছে।

অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য জাতীয় নির্বাচন। ডিসেম্বরে যদি গণপরিষদ নির্বাচন হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, যত দিন নতুন সংবিধান রচনা ও গৃহীত না হয়, তত দিন অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকবে। বিএনপি কি তা মেনে নেবে? আবার খুব শিগগিরই যদি জাতীয় নির্বাচন হয়, ছাত্রদের নতুন দল মাত্র এই কয় মাসে তাদের নতুন দলে কোনো শক্তিই সঞ্চার করতে পারবে না। এসব নিয়ে সমঝোতা না হলে বিরোধ অনিবার্য।

সব রাজনৈতিক দল এখন মোটামুটি তাদের অবস্থান জানান দিয়ে মাঠে নেমেছে। এর মধ্যে আশা করা যায় আলাপ-আলোচনা হবে। একটা রোড ম্যাপ তৈরি হবে, যা সবাই মেনে নেবে। তবে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন মেরুকরণ। জাতীয় গ্র্যান্ড কোয়ালিশন না হলে বিএনপি ও নাগরিক পার্টি নির্বাচনী আঁতাত হবে না, তা ধরে নেওয়া যায়। কারণ, ছাত্ররা নতুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন। জামায়াত ও নাগরিক পার্টির কোয়ালিশনে না হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যদিও নাগরিক পার্টিতে জামায়াতের বেশ কিছু অনুসারী রয়েছেন। নুরু ও জোনায়েদ সাকি কি নাগরিক পার্টির সঙ্গে আসবেন? এসব দেখার জন্য আমাদের কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে।

রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এত দিন সব রাজনৈতিক দল যে সংযম দেখিয়েছে, তা কত দিন টিকে থাকবে? ১ মার্চ নুরুল হক নুরু দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ সরকারে প্রতিনিধিত্বকারী সব ছাত্রকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিচিত ছাত্রদের তদবির, নিয়োগ, টেন্ডার-বাণিজ্যসহ নানাবিধ বিষয়ে সমালোচনা করেছেন।

ধরে নেওয়া যায়, ক্রমে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোও এগিয়ে আসবে ছাত্রদের নতুন দলের সমালোচনায়। তাদের দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে অন্য দলগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। জাতীয় নাগরিক কমিটির জন্য আরেকটা সতর্কতা—তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের লোক রয়েছেন। রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক রেষারেষি। বিএনপির মতো বড় দলকে মোকাবিলা করতে হলে তাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    salehpublic711@gmail.com