মহিউদ্দিন আহমদের কলাম

একটা নমিনেশনের জন্য হাহাকার

অক্টোবরের শেষে একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন পর ফিরব। শুনলাম তুলকালাম হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁরা খুশিতে বাকবাকুম। কিন্তু তালিকায় নিজের নাম না দেখে অনেকেই নাখোশ।

আমি ঢাকায় ফিরব। শুনলাম রাস্তায় অবরোধ। মনোনয়ন না পেয়ে এক নেতা তাঁর সমর্থকদের নিয়ে মাঝরাতে মহাসড়ক আটকে দিয়েছেন। আমাদের রাজনীতির শব্দভান্ডারে এর নাম হলো ‘অবরোধ’।

আমরা অনেক দিন ধরেই দেখছি, রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মঘট, ঘেরাও, হরতালের অস্ত্রটি প্রয়োগ করেও অনেক সময় দাবি আদায় করতে পারে না। সর্বশেষ অস্ত্র হলো অবরোধ। সরকার মাঝেমধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঠেকাতে সান্ধ্য আইন বা কারফিউ জারি করে। কারফিউ চলাকালে ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। বের হলেই গ্রেপ্তার বা গুলি—এ রকম একটা নির্দেশ থাকে। যদিও এটা এখন আর খুব বেশি কার্যকর হয় না।

ছেলেপেলেদের সাহস বেড়ে গেছে। তারা কারফিউতে ভয় পায় না। পুলিশ-মিলিটারিও আজকাল একটু মানবাধিকার চর্চা করে। অনেক সময় গুলি চালায় না। দরকারমতো ধরে পিটুনি দেয় বা ধরে ক্যাম্পে বা থানায় নিয়ে যায়।

সরকার অবরোধ দেয় না। অবরোধ দেয় রাজনৈতিক দল। এটা হচ্ছে ওই দলের জারি করা কারফিউ। অবরোধে সব বন্ধ—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, দোকানপাট, যান চলাচল। সারা দেশ থেকে রাজধানী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কারফিউ দেওয়া হয় মানুষকে ঘরে আটকে ফেলতে। অবরোধেও মানুষ আটকা পড়ে ঘরে। দুটোই জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। একটা দেয় সরকার। বলে যে তারা কারফিউ দিয়ে জানমালের নিরাপত্তা দিচ্ছে। আরেকটা দেয় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের অবরোধ হচ্ছে মহান কিছু দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য চাপ দেওয়া। অবরোধ দিয়ে আজতক কোনো দাবি আদায় হয়েছে বলে শুনিনি।

এটি হচ্ছে জনগণের ওপর রাজনৈতিক দলের একপ্রকার ‘যুদ্ধ’। হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাস্তায় আটকে থেকে অসুস্থ ব্যক্তির মরে যাওয়ার খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটি নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার।

মনে আছে, ১৯৯১ সালে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে দলটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি অগ্রাহ্য করায় দেশে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়।

ওই সময় সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার হরতাল-অবরোধ দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে সারা দেশটাকে একটা যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে ফেলেছিল। ১৯৯৬ সালের জুনে নির্বাচনে জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর দল বিরোধী দলে গেলেও আর কখনো হরতাল দেবে না। ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদল হলে আওয়ামী লীগ আবার বিরোধী দল হয়ে যায়। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রাখেনি। দলটি হরতাল-অবরোধ জারি রাখে।

২০০৭ সালে এক-এগারোর অভ্যুত্থানের ফলে দেশে এসেছিল ‘সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতে, এই সরকার ছিল
ষড়যন্ত্রের ফসল। ওই সময় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা অনেক হয়রানির শিকার হয়েছেন। সাধারণ মানুষ কিন্তু শান্তিতে ছিলেন। ওই দুই বছর দেশে কোনো হরতাল-অবরোধ হয়নি। ২০০৯ সালে দেশে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ কায়েম হলে আমরা আবার ওই হরতাল-অবরোধের অভ্যাসে ফিরে যাই।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা পেয়ে যাই অবাধ স্বাধীনতা। এমন স্বাধীনতা এ দেশের মানুষ এর আগে পায়নি। মানুষের মধ্যে নানান শ্রেণি, নানান গোষ্ঠী, নানান পেশা। তাদের কত রকমের দাবি। দাবি আদায় করতে সবাই মরিয়া। ‘চলো চলো—শাহবাগে চলো। ‘যার যখন খুশি দলবল নিয়ে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন। শাহবাগের চৌরাস্তা আটকে দিতে পারলে সারা শহর অচল করে দেওয়া যায়।

রাস্তা আটকে বসে যাওয়া হলো গণতান্ত্রিক অধিকার, মহান আন্দোলন। অথচ এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। আপনি সরকারি চাকরি করেন। আপনার মর্যাদা আর বেতন-ভাতা নিয়ে আপনি খুশি নন। আপনার কী অধিকার আছে আমার চলাচল বন্ধ করে দিয়ে রাস্তা আটকে দাবি জানানোর? শাহবাগে কি সরকার আছে? সরকার তো সচিবালয়ে? কোনো একটা দাবি নিয়ে ‘আন্দোলন’ যে কীভাবে উপদ্রবে পরিণত হয়, সেটি আমরা দেখেছি। দিনের পর দিন আমরা এই উপদ্রব সহ্য করেছি। আরও হয়তো করতে হবে।

ফিরে আসি শুরুর কথায়। মনোনয়নবঞ্চিতের মহাসড়ক অবরোধ হলো নানান জায়গায়। দলের সিদ্ধান্ত আসে দলের নেতাদের কাছ থেকে। সেই সিদ্ধান্ত প্রচার করা হয় দলের অফিস থেকে। দলের অফিস বা নেতাদের ঘেরাও না করে সাতক্ষীরা বা সীতাকুণ্ডে রাস্তা আটকে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে কেন এই ভোগান্তিতে ফেলা? গত সাড়ে পাঁচ দশকের রাজনীতির হালচাল আর রাজনীতিবিদদের আচরণের একটা ফিরিস্তি দিলে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাদের প্রধান কাজ হলো মানুষকে কষ্ট দেওয়া।

নির্বাচিত হলে যে প্রাপ্তিযোগ ঘটে, তার আকার ও প্রকার ব্যাপক ও বিশাল। এটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মানে স্বর্গের টিকিট না পাওয়া। এটি কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। সে জন্য নানান কৌশল নিতে হয়। এ জন্য দলের নেতাদের যত বেশি চাপে রাখা যায়, ততই নিজেকে করে তোলা যায় গুরুত্বপূর্ণ। চাপ দিয়ে মনোনয়ন বদলে ফেলার উদাহরণও আছে।

ধরা যাক, একটি দলের পক্ষে জোয়ার উঠেছে। নির্বাচনী যুদ্ধে ওই দলের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। এটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে ওই দলের টিকিটে নির্বাচন করলে মোক্ষলাভ হবে। এ জন্য তাঁরা প্রচুর বিনিয়োগ করতে পিছপা হন না। একেকটি সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থীর কত খরচ হয়, তা কেবল তিনিই জানেন। টাকার অঙ্কটি দশ-বিশ-পঞ্চাশ কোটির নিচে নয় বলেই জনশ্রুতি আছে।

এত টাকা তাঁরা কোথায় পান, এটি একটি প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো তাঁরা এত টাকা কেন খরচ করেন? তাঁদের কী লাভ? তাঁরা তো মুখে বলছেন তাঁরা জনগণের সেবা করতে চান। সেবা করার জন্য সংসদ সদস্য হতে হবে, আর সংসদ সদস্য না হলে জনসেবা করা যাবে না, এটা কোন কিতাবে আছে?

জাতীয় সংসদের সদস্যরা যে দেশের অলিখিত একটি মালিক সমিতি হয়ে উঠেছেন, তা তো বেশ স্পষ্ট। কী নেই তাঁদের হাতে? তাঁদের হাতে আছে আলাদিনের চেরাগ। সেটা দিয়ে তাঁরা পেয়ে যান অর্থ, বিত্ত আর প্রতিপত্তি। একটি অঞ্চলের তালুক। সেখানে তিনিই রাজাধিরাজ, আর সবাই প্রজা। এ দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে আছেন ৩০০ সার্বভৌম জমিদার। এ রকম একটা অবস্থানে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি তো থাকবেই। একটা ‘নমিনেশন’-এর জন্য তাই এত হাহাকার।

আসন একটি। সেবকের সংখ্যা একাধিক। তাঁরা কেউ ওই দলের দীর্ঘদিনের কান্ডারি, কেউ ত্যাগী, কেউ প্রভাবশালী, কারও টাকার ঝুলি বড়, কেউবা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতার খাতিরের লোক। এসব বিবেচনায় নিয়েই মনোনয়ন দেওয়া হয়। যেহেতু একাধিক ব্যক্তি মনোনয়ন চান, এবং প্রত্যেকেই নিজেকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেন, সেখানে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে গুটিয়ে আনার ইচ্ছা অনেকের থাকে না। তা ছাড়া সমাজে তো মুখ দেখাতে হবে।

নির্বাচিত হলে যে প্রাপ্তিযোগ ঘটে, তার আকার ও প্রকার ব্যাপক ও বিশাল। এটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া মানে স্বর্গের টিকিট না পাওয়া। এটি কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। সে জন্য নানান কৌশল নিতে হয়। এ জন্য দলের নেতাদের যত বেশি চাপে রাখা যায়, ততই নিজেকে করে তোলা যায় গুরুত্বপূর্ণ। চাপ দিয়ে মনোনয়ন বদলে ফেলার উদাহরণও আছে।

মনোনয়ন পেয়ে যাওয়ার পর একটাই লক্ষ্য থাকে, জিততে হবে। যেখানে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন, সেখানে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। সেটি আর ভোটকেন্দ্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যথেচ্ছ চেঁচামেচি, মারামারি, খুনোখুনির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আগামী সংসদ নির্বাচন দেশের জন্য আরেকটি মালিক সমিতি নির্ধারিত হতে যাচ্ছে বলেই মনে হয়।

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

    *মতামত লেখকের নিজস্ব