ভারত মুসলিমদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও পশ্চিমা বিশ্বে ভারত গণতান্ত্রিক অংশীদার হিসেবে অভ্যর্থনা পায়।
ভারত মুসলিমদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও পশ্চিমা বিশ্বে ভারত গণতান্ত্রিক অংশীদার হিসেবে অভ্যর্থনা পায়।

মতামত

ইসলামবিদ্বেষ এখন ক্ষমতার রাজনীতির নতুন মুদ্রা

আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, সেটাকে সবচেয়ে সৎ ভাবে বর্ণনা করা যায় এভাবে—ইসলামবিদ্বেষ এখন বৈশ্বিক ক্ষমতার নতুন মুদ্রা। রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায়, কূটনীতিকদের চুক্তিতে, সংবাদপত্রের পাতায় এবং নিরাপত্তা বা সন্ত্রাসবিরোধী ভাষ্যে এই মুদ্রা বেশ ভালোভাবেই চলে। এই মুদ্রা গণহত্যার দায়মুক্তি দেয়, স্বৈরশাসককে দেয় বৈধতা, আর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের নতুন বাজার গড়ে তোলে। গাজার গণহত্যা দেখিয়েছে, মুসলমানের রক্ত শুধু সস্তা নয়; বরং বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর অর্থনীতির জন্য বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি।

গাজার দিকে তাকান। দুই বছর ধরে বিশ্ব দেখছে, অবরুদ্ধ একটি জাতিকে কীভাবে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে পরিবারগুলোর কবর রচিত হচ্ছে, হাসপাতালে বোমা হামলা হচ্ছে, শিশুরা ক্ষুধায় যন্ত্রণায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকা

যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের ‘মানব পশু’ বলেন এবং পশ্চিমা নেতারা মন্ত্র জপের মতো করে বলতেই থাকেন, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’, তখন নিরাপত্তা নয়, বিমানবিকীরণের রাজনীতিই কার্যকর হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বদলে ইসরায়েল পেয়েছে আরও অস্ত্র, আরও কূটনৈতিক সহায়তা, আরও অর্থ।

গাজার গণহত্যা বিচ্ছিন্ন কোনো বিপর্যয় নয়, এটি একটি বৈশ্বিক প্রবণতার কেন্দ্রীয় বিষয়। চীনে উইঘুর মুসলমানদের বন্দী করে রাখা, মিয়ানমারের আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন, সেক্যুলারিজমের নামে ফ্রান্সে মুসলিম মেয়েদের হিজাব খুলে ফেলা, আর যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নিরাপত্তার নামে ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’—সবখানেই একই যুক্তি কাজ করে। ইসলামবিদ্বেষ এখন গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্র, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র থেকে খোলাখুলি জাতিবাদী রাষ্ট্র—সবখানেই ক্ষমতার সাধারণ ভাষা। এটিকে আশ্রয় করে নিষ্ঠুরতাকে ব্যবস্থা, বর্ণবাদকে নিরাপত্তা ও গণহত্যাকে নীতি হিসেবে দেখা হয়।

ভারত মুসলিমদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও পশ্চিমা বিশ্বে ভারত গণতান্ত্রিক অংশীদার হিসেবে অভ্যর্থনা পায়। এর কারণ হলো ভারতের প্রোপাগান্ডা পশ্চিমাদের মুসলিমবিষয়ক নিরাপত্তার ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়। এ কারণেই ইসলামবিদ্বেষ শুধু সংস্কার নয়, এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে ব্যবসাযোগ্য রাজনৈতিক পণ্য।

ফিলিস্তিনের বাইরে ইসলামবিদ্বেষের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলো ভারত। সেখানে ২০ কোটি মুসলমানকে আরএসএস-বিজেপির শাসন একেবারে প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতে ইসলামবিদ্বেষ এখন রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন মুসলমানদের তাঁদের নিজ ভূমিতে রাষ্ট্রহীন করে দিতে পারে। এগুলোর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি পরিকল্পিত প্রকল্পের অংশ।

এই প্রকল্পে জায়নবাদ থেকে সরাসরি প্রোপাগান্ডার কৌশল ধার করা হয়েছে। ইসরায়েলে যেমন ফিলিস্তিনিদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেখানো হয়, ভারতের ক্ষেত্রেও তেমনি মুসলমানদের ‘জিহাদি’ বা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলা হয়। গাজার প্রতিরোধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, ভারতের মুসলিমদের প্রতিবাদকেও রাষ্ট্রবিরোধী বলা হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তেল আবিবে তোলা।

অনেক সমালোচক মনে করেন, ‘ইসলামবিদ্বেষ’ শব্দটি খুব শক্ত শোনায়। এখানে ধর্মের সমালোচনা ও মানুষের প্রতি নির্যাতন একত্রে করে দেখানো হয়। কিন্তু আসলে বিষয়টা অন্য রকম। এটা কোনো ধর্মীয় মতের সমালোচনা নয়; বরং মানুষকে আলাদা করার রাজনৈতিক কৌশল। মাহমুদ মামদানি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘ভালো মুসলমান’ ও ‘খারাপ মুসলমান’ এভাবে ভাগ করাটা বিশ্বাসের বিষয় নয়; বরং শাসনের বিষয়। একটি রাষ্ট্রে কোন মুসলমান নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারবে, আর কাকে সমস্যা হিসেবে দেখা হবে, সেই বিষয়টি এর সঙ্গে জড়িত।

ইসলামবিদ্বেষকে এতটা অনন্যভাবে শক্তিশালী করে তোলার কারণ হলো, এটি একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজে লাগানো যায়। দেশের ভেতরে এটি সংখ্যাগরিষ্ঠদের একত্র করে, অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয় এবং শাসকের হাতে নিপীড়নের লাইসেন্স তুলে দেয়। আন্তর্জাতিকভাবে এটি জোটবদ্ধ এক ভাষ্য উৎপাদন করতে পারে। আর সেটা হলো, ইসরায়েল মার্কিন বোমা দিয়ে গাজা ধ্বংস করতে পারে। কেননা, দুটি দেশই সন্ত্রাসবিরোধী ভাষায় কথা বলে।

ভারত মুসলিমদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও পশ্চিমা বিশ্বে ভারত গণতান্ত্রিক অংশীদার হিসেবে অভ্যর্থনা পায়। এর কারণ হলো ভারতের প্রোপাগান্ডা পশ্চিমাদের মুসলিমবিষয়ক নিরাপত্তার ইতিহাসের সঙ্গে মিলে যায়। এ কারণেই ইসলামবিদ্বেষ শুধু সংস্কার নয়, এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে ব্যবসাযোগ্য রাজনৈতিক পণ্য।

যদি ইসলামবিদ্বেষ ক্ষমতার মুদ্রা হয়, তবে এর প্রতিরোধ অবশ্যই বিপরীত অর্থনীতি দিয়ে হতে হবে। এ প্রতিরোধ অবশ্যই আন্তর্জাতিক হতে হবে। কারণ, ইসলামবিদ্বেষের স্বরূপটাও আন্তর্জাতিক। গাজাকে কাশ্মীরের সঙ্গে, শিনজিয়াংকে রোহিঙ্গা শিবিরের সঙ্গে, প্যারিসের শহরতলিকে দিল্লির বস্তির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটা মনে করতে হবে যে শোকের কোনো উচু-নিচু ভেদ নেই; সব মৃত্যুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন–মার্কিন শিক্ষাবিদ এডওয়ার্ড সাইদের ভাষায়, মানুষের দুর্ভোগ অবিচ্ছিন্ন, মুসলমানদের দুর্ভোগ কম ট্র্যাজেডি নয়।

  • ইসমাইল সালাউদ্দিন ভারতের লেখক ও গবেষক, যিনি মুসলিম পরিচয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন
    মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত