নগরভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা সমর্থকদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন ইশরাক হোসেন।
নগরভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা সমর্থকদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন ইশরাক হোসেন।

মতামত

৯ মাসেই কেন এমন বিরোধ, অবিশ্বাস

বাংলাদেশের সমাজ তীক্ষ্ণভাবে রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিভাজিত হলেও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে জনতার সম্পর্কটা সমানভাবে বিচ্ছিন্ন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। কেননা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনতার মধ্যে এসে কংক্রিটের শক্ত দেয়াল তৈরি করে গোষ্ঠীতন্ত্র। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমল থেকে আমাদের অর্থনীতি যেমন মধ্যস্বত্বনির্ভর, এখানকার রাজনীতিও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর।

রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি, বক্তব্য-বিবৃতিকে আমরা রাজনীতি বলে চিনি ও জানি। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কোন গোষ্ঠীগুলোর হাতে থাকছে, সেটাও রাজনীতির বড় প্রশ্ন।

দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের এখানে কাউকে ক্ষমতা থেকে সরানোর একমাত্র পথ রাজপথে শক্তির প্রদর্শন। আবার বিরোধী অবস্থান থেকে সরকারে বসলেই সবার ভাষা ও ভঙ্গি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। জনতার ভাষার জায়গাটায় চলে আসে গোষ্ঠীতন্ত্রের ভাষা।

জনতার আকাঙ্ক্ষা, প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর চাওয়ার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশা ও কর্মসূচি যখন একবিন্দুতে এসে মেলে, তখনই রাজনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের শর্ত তৈরি হয়। যেমনটা আমরা দেখেছি চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়।

বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার সঙ্গে জনতার আকাঙ্ক্ষার মিল থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে দলীয় সমর্থকগোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষ নামেনি। এর কারণ হলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক। ক্ষমতায় গেলে কোনো দলই গোষ্ঠী নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে উঠে জনতার সরকার হয়ে উঠতে পারেনি।

চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান সেই পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তটা ভেঙে ফেলার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একমাত্র আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছাড়া সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, এমন মা–বাবার সন্তানেরাও নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদে, হাসিনা সরকারের পতনের দাবি জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। সেখানে নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, বাঙালি-বাংলাদেশি-আদিবাসীর মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। সবখানেই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষার কথা জোরেশোরে বলা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নকে নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিল।

১৯৭১ ও ১৯৯০—দুবার বড় পরিবর্তনের সুযোগের মুখোমুখি হয়েছিল এ ভূখণ্ডের মানুষ। কিন্তু দুবারই আমরা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত, আরেকবার অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর অনৈক্য, সেই ব্যর্থতাকে ডেকে এনেছিল। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম ভাষণে আমরা সেই বাস্তবতারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই—উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার।আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

এ বক্তব্য সবাইকেই সমানভাবে আশাবাদী করেছিল।

কিন্তু ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যুত্থানের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে গেল। অভ্যুত্থানকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি হিসেবে না দেখে দলীয় অবদান ও হিস্যা হিসেবে দেখা শুরু হলো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, আদালতের কেন্দ্রীয় পদগুলোতে যোগ্যতা, মেধার বদলে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভাগাভাগি করে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত ডানপন্থীদের জায়গা করে দেওয়া হলো।

অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক সরকার বলা যাবে না। কিন্তু যত দিন গড়াচ্ছে, ততই সরকারের কর্মকাণ্ডে গোষ্ঠীস্বার্থের প্রশ্নটি সামনে আসছে। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের আচরণ কোথাও কি ঠান্ডা, কোথাও কি গরম? কেননা শুরু থেকেই কোনো কোনো গোষ্ঠী নির্বিঘ্নে মাজার ভাঙচুর, ওরস বন্ধ, মেলা বন্ধ, গাছ কাটা, অগ্নিসংযোগ, বাড়ি ঘেরাও করে আটক থেকে শুরু করে এমন কোনো মব সহিংসতা নেই যে তা করেনি। বিবৃতি দেওয়া ছাড়া এগুলো বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

এই আশকারা শেষ পর্যন্ত জনপরিসরে নারীর চলাফেরা ও পোশাকের ওপর মোরাল পুলিশিংয়ে রূপ নিল। সব মিলিয়ে এটা এমন এক মবক্রেসি তৈরি হলো, যার জের আরও অনেক দিন বাংলাদেশের সমাজকে টানতে হবে।

সরকারের ঠান্ডা ও গরম আচরণের দৃষ্টান্ত আমরা সর্বসম্প্রতিও দেখা গেল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপি ও ইসলামি দলগুলোর ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচিতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ঠান্ডা পানির ধারা বর্ষণ করা হলো। এটা সত্য যে রাষ্ট্র ও সরকার এমন মানবিক হবে বলেই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ১ হাজার ৪০০ মানুষ জীবন দিয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগ শিশু ও তরুণ। জীবনের বাস্তবতাকে দেখার আগেই তাঁদের জীবন থেমে গেছে। আর কয়েক হাজার মানুষ অঙ্গ হারিয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন, তাঁদের জন্যও দুর্বিষহ এক জীবনবাস্তবতা।

বিপরীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে লাঠিপেটা থেকে শুরু করে জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা সরকারের এই বিপরীতমুখী আচরণকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সেই ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রার একেবারে শুরু থেকেই এই দ্বিমুখী আচরণ দেখা যাচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে গরম, কারও কারও ক্ষেত্রে ঠান্ডা—এই দ্বিমুখী আচরণের কারণেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থীদের একটা অংশের প্রতি সরকারের আশীর্বাদ রয়েছে কি না।

দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস পর এসে অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিকভাবে সংকটজনক মুহূর্ত পার করতে হচ্ছে। এ সংকটের সূচনাবিন্দুটা হতে পারে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে এনসিপির কর্মসূচি। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলও একই দাবি নিয়ে মাঠে নামে। একপর্যায়ে সরকার নির্বাহী আদেশে অনলাইন ও অফলাইনে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়। বিএনপি কর্মসূচিতে না নামলেও সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়।

নির্বাচন কমিশন বিএনপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, এমন আওয়াজ তুলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে এনসিপি কর্মসূচি পালন করে।

এরপর আমরা এনসিপি আর বিএনপিকে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে দেখলাম। নির্বাচন কমিশন বিএনপির প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, এমন আওয়াজ তুলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে এনসিপি কর্মসূচি পালন করে। অথচ নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই এবারের কমিশন গঠন করা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেনের মেয়র ঘোষণা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিএনপি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদের পদত্যাগের দাবি জানায়। এনসিপি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তিনজন উপদেষ্টাকে পদত্যাগের দাবি জানায়।

দুই পক্ষের বাগ্‌যুদ্ধ, পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই বিভাজনটা আরও বিস্তৃত হলো সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের তকমার রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্য দিয়ে। কে কতটা বেশি বিদেশি এজেন্ট, তা প্রমাণে তারা উঠে–পড়ে লাগেন। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে দৃঢ় ঐক্যটা থাকা দরকার, তার বদলে একে-অপরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দূরত্ব তৈরি হলো।

একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। যাহোক, দ্রুতই রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিবৃতি দেওয়ায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ হওয়ায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি সংকটের সমাধান হলো?

অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, এনসিপি— কারও কর্মকাণ্ডেই এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হলো, দুনিয়াকাঁপানো চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার যে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল, মাত্র ৯ মাসের মাথায় এসে সেটা কেন এত বড় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল? গোষ্ঠীতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা কি কখনই বের হতে পারব না?

১৯৭১ ও ১৯৯০—দুবার বড় পরিবর্তনের সুযোগের মুখোমুখি হয়েছিল এ ভূখণ্ডের মানুষ। কিন্তু দুবারই আমরা নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত, আরেকবার অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর অনৈক্য, সেই ব্যর্থতাকে ডেকে এনেছিল। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী