গত ২৬ আগস্ট রাজধানীতে ‘বাংলা চলচ্চিত্র বা কনটেন্টে সেন্সরশিপের খড়্গ: গল্প বলার স্বাধীনতা চাই’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন চলচ্চিত্রের শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা
গত ২৬ আগস্ট রাজধানীতে ‘বাংলা চলচ্চিত্র বা কনটেন্টে সেন্সরশিপের খড়্গ: গল্প বলার স্বাধীনতা চাই’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন চলচ্চিত্রের শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা

মতামত

বোবা সময়ের গল্প: ঔপনিবেশিক কাঁটাতারে বন্দী নির্মাতারা

সিনেমার জন্য প্রস্তাবিত সার্টিফিকেশন অ্যাক্ট পড়ার পর থেকেই প্রশ্নটা ঘুরছে মাথায়। গান, বাজনা, আলোকচিত্র বা শিল্প প্রদর্শনীর প্রচার বা প্রকাশে যদি কোনো সার্টিফিকেট না লাগে, তাহলে সিনেমায় কেন লাগে? ঘঁাটতে গিয়ে দেখলাম, এই ঘটনার শুরু ১৮৯৭ সালে প্যারিসে। প্রতিবছর চ্যারিটির জন্য একটা মেলা (বাজার দে’লা শারিতে) করত ফরাসি অভিজাত বা এলিট সোসাইটি। সেই বছরের মেলাটা বসেছিল একটা বিশাল কাঠের আড়ত বা ওয়্যারহাউসে। পুরোনো দিনের রাস্তার আদলে মেলা সাজানো হয়েছিল মূলত কাঠ, পিচবোর্ড, কাপড় এবং কাগজের মণ্ড দিয়ে। মেলার মূল আকর্ষণই ছিল সিনেমা। সেই সময় সিনেমার মেশিন চলত ইথার বা স্পিরিটের কুপিতে। হঠাৎ সেই মেশিনে আগুন লেগে মারা যান ১২৬ জন মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই আবার ছিলেন বনেদি পরিবারের নারী। এই নিয়ে নেটফ্লিক্সে একটা ফরাসি মিনি সিরিজও আছে, দ্য বনফায়ার অব ডেসটিনি নামে। সেই যুগে বেশির ভাগ সিনেমাঘর বানানো হতো মেলার মাঠ বা পেনিগ্রাফ মানে গরিবের থিয়েটারে। আর ফিল্ম স্টক তৈরি হতো নাইট্রোজেন বেইজে, যাতে আবার খুব সহজেই আগুন লাগে। ফলে এ রকম একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটতে থাকায় সিনেমাঘরের সেফটি কোড বা নিরাপত্তা বিধান করার জন্য ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট বলে একটা আইন পাস করা হয়।

গত ১০০ বছরে কত সীমানা বদলাল, দেশ স্বাধীন হলো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো, কত সরকার বদলাল, দুনিয়া কোত্থেকে কোথায় চলে গেল; কিন্তু আমাদের সেন্সরবোর্ড এখনো ১৯১৮ সালের ঔপনিবেশিক কাঠামো বা ভাষার বাইরে বের হতে পারল না।

মজার ব্যাপার হলো, এই আইনের দোহাই দিয়েই পরে কী ছবি দেখানো হবে বা হবে না—এ বিষয়ে স্থানীয় আয়োজক, বাজার কমিটি বা গির্জার পাদরিরা ‘মাতব্বরি’ শুরু করেন। যার ফলে সিনেমাঘরের নিরাপত্তার জন্য বানানো একটা আইন সিনেমার নিবর্তনমূলক আইনে পরিণত হয়। ঘটনাটা ১৯১২ সালের অক্টোবরের, যিশুর জীবনীর ওপর ভিত্তি করে বানানো আমেরিকান ছবি ফ্রম দ্য মেঞ্জার টু দ্য ক্রস (গরুর গামলা থেকে ক্রুশ পর্যন্ত) নিয়ে রক্ষণশীল ব্রিটেনে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিজ উদ্যোগে তৈরি করে স্বায়ত্তশাসিত, অলাভজনক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সর; যেটি এখনো ব্রিটিশ বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন নামে কোনো প্রকার সরকারি হস্তক্ষেপের বাইরে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সব রকম ছবির সনদ দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে। অথচ এর ছয় বছর পর ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত উপমহাদেশের জন্য সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট তৈরি হয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯০৯ সালে পাস হওয়া পুরোনো আইনটির আদলে। ১৯২০ সালে কার্যকর হওয়া আইনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি: (১) দর্শকদের নিরাপত্তা বিধান করা এবং (২) আপত্তিকর চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী বন্ধ করা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘আপত্তিকর চলচ্চিত্র’ বলতে ব্রিটিশরাজ স্বভাবতই সেই সব ছবিকে বোঝাত, যেগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বকে প্রশ্ন করে এবং স্বদেশি বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। এরপর গত ১০০ বছরে কত সীমানা বদলাল, দেশ স্বাধীন হলো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো, কত সরকার বদলাল, দুনিয়া কোত্থেকে কোথায় চলে গেল; কিন্তু আমাদের সেন্সরবোর্ড এখনো ১৯১৮ সালের ঔপনিবেশিক কাঠামো বা ভাষার বাইরে বের হতে পারল না। এতবার অদলবদলের পরেও ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা সেই নিপীড়নমূলক আইনের স্পিরিট অব দ্য ল বা মূলভাবনা আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে, পঁচাত্তর–পরবর্তী সামরিক শাসনামল থেকে নব্বই–পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের যুগেও, কী ভাষায়, কী সংস্কৃতিতে—শাসক আর শাসিতের সেই পুরোনো আমরা-তোমরার বাইনারি মেজাজেই থেকে গেল।

ইতিহাস জানাটা জরুরি, ইতিহাস না জানলে প্রশ্ন তোলা যায় না। প্রশ্ন তোলাটা জরুরি, প্রশ্ন ছাড়া সহমত সমাজ তৈরি হয়। মজা পুকুরের মতো তাতে কোনো নতুনের আবাদ হয় না। যুগের চ্যালেঞ্জটাও আমলে নেওয়া দরকার। ডিজিটাল বেনো জলে ভেসে গেছে আজকের দুনিয়া, অন্তর্জালের এই সময়ে ডিজিটাল নো ম্যানস ল্যান্ডে মানুষের বসত। তাবৎ দুনিয়ার সিনেমা, টিভি সিরিজ পকেটে নিয়ে শাহবাগ থেকে শাপলা চত্বর ঘুরে বেড়ায় আজকের তরুণ। তামিল, তেলেগু, তেলেঙ্গানা—কোনো কন্টেন্ট দেখতেই তার কোনো সার্টিফিকেট লাগে না, কেবল নিজের দেশের সিনেমা ছাড়া। অনেক দিন থেকেই হলিউডের ব্লকবাস্টার ছবিগুলো সারা দুনিয়ার সঙ্গে প্রায় একই দিনে মুক্তি পায় বাংলাদেশের সিনেপ্লেক্সে। ওটিটির বদৌলতে আজকাল শুধু হলিউডের নয়, বলিউডের টাটকা ছবিও দেখা যায় সহজেই এবং কোনো প্রকার রেগুলেশন বা সেন্সর ছাড়াই।

হুমায়ূন আহমেদ ও তারেক মাসুদ–পরবর্তী সময়ে গত ১০ বছরে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা বিশ্ব চলচ্চিত্র মঞ্চে একের পর এক নতুন দুয়ার খুলছেন। বাণিজ্য–সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ওটিটির বাজার দাঁড়াবে এক হাজার কোটির। এই দশকেই এশিয়ার অন্যতম অর্থনীতি হওয়ার হাতছানি বাংলাদেশের সামনে। অথচ এই নতুন বাংলাদেশের ইমেজ তৈরি করবেন যে নির্মাতা, তঁাদেরকে এখনো গল্প বলার স্বাধীনতার দাবিতে কাঁটাতারের বেড়ার পেছনে গিয়ে বসতে হয়।

অর্থনীতিই একটা দেশের উন্নয়নের একমাত্র সূচক নয়, সমাজ-সংস্কৃতির সূচকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটা শুধু সিনেমা বা কনটেন্ট সেন্সর বা সার্টিফিকেশনের না, প্রশ্নটা প্রকাশের স্বাধীনতার, প্রশ্নটা এই বোবা সময়ের ব্র্যান্ডিংয়ের। শিল্পীরা বোবা হয়ে গেলে, সমাজ বোবা হয়ে যায়। অ্যাপলিটিক্যাল কোনো আর্ট নেই, পলিটিক্যালি কারেক্ট মানে প্রোপাগান্ডা। তাঁবেদারি শিল্পচর্চা তাঁবেদার সমাজ তৈরি করে। দর্শনের অভাবে যেমন দিক হারায় রাজনীতি; সংস্কৃতির অভাবে তেমনি পথ হারায় সমাজ। শিল্পী বা শিল্পের কাজই হলো চোখে আঙুল তুলে সেই পথটা দেখিয়ে দেওয়া।

কামার আহমাদ সাইমন স্থপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

kamarahmad@gmail.com