মতামত

বিষাক্ত বাতাসে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, ব্যক্তিপর্যায়েও রয়েছে সমাধান

বায়ুদূষণ একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ঢাকাসহ আশপাশের শহরগুলোর বাতাস বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের অন্য শহরগুলোর মধ্যে প্রায়ই শীর্ষে অবস্থান করে। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকাবাসী একটি দিনও নির্মল বায়ুর নিশ্বাস নিতে পারেনি।

‘এয়ার ভিজ্যুয়ালের’ বায়ুর মান সূচক ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ অনুসারে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ঢাকার বায়ু বেশির ভাগ দিনই খুব অস্বাস্থ্যকর ছিল। ঢাকাবাসী প্রতিনিয়ত বিষাক্ত নিশ্বাস নিচ্ছে, যার ফলে রয়েছে মারাত্মক জনস্বাস্থ্যঝুঁকিও।

বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যসমস্যাগুলো হলো শ্বসনযন্ত্র-সম্পর্কিত রোগ, হৃদ্‌রোগ, ফুসফুস ক্যানসার, নির্ধারিত সময়ের আগে শিশুর জন্ম, কম ওজনের শিশুর জন্ম, মৃত শিশু প্রসব, মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা, শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশজনিত স্বাস্থ্যসমস্যা ও অপমৃত্যু।
সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে বায়ুদূষণ–সংবেদনশীল গ্রুপ, যেমন শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের আগে থেকে শ্বসনযন্ত্র-সম্পর্কিত রোগ, হৃদ্‌রোগ ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে।

বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা। কারণ, শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে অনেক বেশি, তাই শিশুরা অনেক বেশি পরিমাণে দূষিত বায়ু নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে।

বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছেন।

ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের এত স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকার পরও সাধারণ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যথেষ্ট সচেতন নন। এর কারণ, বায়ুদূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের মাধ্যমে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ যখন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে, পৃথিবীব্যাপী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সবাই খুবই সচেতন হয়।

এমনকি কোভিড-১৯-এর কারণে অনেক শহর ও দেশ সম্পূর্ণরূপে মানুষ চলাচল বন্ধ করে দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ড্যাশবোর্ডের তথ্য অনুসারে, গত তিন বছরে কোভিড-১৯-এর কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ মারা গেছেন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, এক বছরেই বায়ুদূষণের কারণে ৭০ লাখ মানুষ মারা যান।
ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলো হলো যানবাহন থেকে নিঃসরিত ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার, ইটভাটা, নির্মাণাধীন কাজ এবং রাস্তাঘাট সংস্কার থেকে আসা ধুলাবালু।

এ ছাড়া ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশের বায়ুদূষণের একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসে। শীতকালে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ অনেক বেড়ে যায়। কারণ, শীতকালে বায়ুদূষণের স্থানীয় উৎসগুলোর কার্যক্রম অনেক গুণ বেড়ে যায়—যেমন ইটভাটা, ভবন নির্মাণ ও রাস্তাঘাট সংস্কারের কাজ। এ সময় বৃষ্টিপাত না থাকায় প্রচুর ধুলাবালু সৃষ্টি হয়।

বাতাস জনসম্পদ হওয়ায় আমরা যত সহজে শহরের বায়ু দূষণ করতে পারি, বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা ও নিয়ন্ত্রণ করা ততটাই কঠিন ও জটিল কাজ। আসলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। এর মানে হলো, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেই অল্প সময়ের মধ্যে বায়ুদূষণ কমে যাবে—ব্যাপারটি এমন নয়। এখানে যেমন বায়ুদূষণের অনেক স্থানীয় উৎস আছে, তেমনি বায়ুদূষণের মধ্যে জটিল রসায়নও বিদ্যমান। মাঝেমধ্যে একধরনের বায়ুদূষণ কমালে আরেক ধরনের বায়ুদূষণ বেড়ে যায়।

সাধারণ জনগণ মনে করে, শহরের বায়ুদূষণ ও এর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সরকারের দায়িত্ব, তাদের কিছু করার নেই। তারা এ শহরে বসবাস করে, এটা তাদের ভাগ্য। তাই তারা মনে করে, বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি তাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। ব্যক্তিপর্যায়ে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে রয়েছে অনেক করণীয়, রয়েছে সমাধানও।

তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য ধারাবাহিক বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, পদক্ষেপ ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বহুখাতভিত্তিক কৌশল ও পারস্পরিক সহযোগিতা।

যেহেতু শহরের বায়ুদূষণ একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা এবং প্রতিনিয়ত বিষাক্ত নিশ্বাস আমাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে, তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং নানামুখী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ জনগণ মনে করে, শহরের বায়ুদূষণ ও এর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সরকারের দায়িত্ব, তাদের কিছু করার নেই। তারা এ শহরে বসবাস করে, এটা তাদের ভাগ্য। তাই তারা মনে করে, বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি তাদের মেনে নিতে হবে। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। ব্যক্তিপর্যায়ে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে রয়েছে অনেক করণীয়, রয়েছে সমাধানও।

শহরের মানুষ তার দিনের সবটুকু সময়ের মধ্যে মাত্র ১০ ভাগের কম সময় বাইরের পরিবেশে থাকে, আর ৯০ ভাগের বেশি সময় অভ্যন্তরীণ পরিবেশে থাকে—যেমন বাসা, অফিস, স্কুল-কলেজ, শপিং মল। এসব অভ্যন্তরীণ পরিবেশে যদি অভ্যন্তরীণভাবে বায়ুদূষণের উৎস না থাকে, তাহলে বাইরের তুলনায় সেখানকার পরিবেশে বায়ুদূষণ কম থাকে।

তাই যখন বাইরের বায়ুদূষণ অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকে, তখন বায়ুদূষণ–সংবেদনশীল মানুষদের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা জরুরি কাজে বাইরে গেলেও অল্প সময়ের জন্য এবং মাস্ক পরে যেতে হবে। চীনের নানজিং প্রদেশে পাতালরেল স্টেশনের বায়ুদূষণের ওপর একটি গবেষণা ‘এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ’ জার্নালে ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। সে গবেষণায় দেখা যায়, সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের ফলে পার্টিকুলেট ম্যাটারের (পিএম ২.৫) ধাতব যৌগ নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণের মাত্রা পাতালরেল স্টেশনের যাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ এবং শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ কমে যায়।

অস্বাস্থ্যকর বায়ুদূষণের দিনগুলোয় শহরের রাস্তায় যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বায়ুদূষণের কম স্বাস্থ্যঝুঁকিসম্পন্ন যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে যানবাহনভেদে বায়ুদূষণের মাত্রা–সম্পর্কিত আমাদের একটি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে উঠে এসেছে, এয়ার কন্ডিশনসহ জানালাবন্ধ গাড়ির ভেতর বায়ুদূষণ অন্যান্য গাড়ির তুলনায় অনেক কম। তাই এসব গাড়িতে বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তুলনামূলক কম।

বাইরের দূষিত বায়ু আবার অভ্যন্তরীণ বা ভেতরের পরিবেশে অনুপ্রবেশ করে এবং ভেতরে অবস্থানরত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। বাইরের পরিবেশ থেকে ঘরের ভেতরে দূষিত বায়ুর অনুপ্রবেশ বিভিন্ন উপায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। ২০২১ সালে বাইরে থেকে ঘরের অভ্যন্তরে বায়ুদূষণের অনুপ্রবেশের ওপর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘বিল্ডিং অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত আমার একটি গবেষণালব্ধ ফলাফলের সূত্রমতে, ঘরের ভেতর জানালা বন্ধ রাখলে প্রায় ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত পিএম ২.৫ বাইরে থেকে ভেতরে বায়ুদূষণের অনুপ্রবেশ কমে যায়।

গরমের দিন হলে জানালা বন্ধ এবং এয়ার কন্ডিশন চালু রাখা যেতে পারে, তাতে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে। ঘরের ভেতর এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে হবে। একটি গবেষণায় আমরা পেয়েছি, হেপা-ফিল্টারসহ এয়ার পিউরিফায়ার ঘরের ভেতরে পিএম ২.৫-এর দূষণ অনেক কমিয়ে দেয়।

আমার পরামর্শ হলো, অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক বায়ুদূষণের দিনগুলোয় বায়ুদূষণ–সংবেদনশীল ব্যক্তিদের ঘরে ও অফিসের ভেতরে অবস্থান, জানালা বন্ধ রাখা এবং এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করা উচিত।

নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট, যা কিনা মানুষ চাইলেই কমিয়ে আনতে পারে। ঢাকা শহরের বিষাক্ত নিশ্বাসে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। সুতরাং, বায়ুদূষণ–সংবেদনশীল মানুষদের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।

  • ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য–গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: shakhaoat@juniv.edu