সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে

মতামত

বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে ভিসা অনিশ্চয়তা

মেধাবী তরুণ-তরুণীদের কাছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা শুধু একটি লক্ষ্য নয়; বরং জীবন পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা। যেখানে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অসংখ্য গবেষণার সুযোগ মেলে, সেটিই হয়ে ওঠে অনেকের জীবনের মোড় ঘোরানোর আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই স্বপ্নপথে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিসা–সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা।

নাম নাই–বা বললাম। গত বছর অনার্স শেষ করা বাংলাদেশের এক তরুণী এ বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি-সংক্রান্ত অফার লেটার পেয়েছিলেন। কিন্তু ভিসা নেওয়ার জন্য ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। প্রথম দিকে কোনো সময়সূচি না পেয়ে হাল ছাড়তে হয়। পরে মে মাসে আবার চেষ্টা করলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মেলে ঠিকই, তবে সেটা ডিসেম্বর মাসে, অর্থাৎ সাত মাস পর। স্বাভাবিকের তুলনায় এই দীর্ঘ অপেক্ষা তাঁর জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে ভর্তি স্থগিত করে পরবর্তী সেমিস্টারে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে হয়।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আজ দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। তাঁদের চোখে যে স্বপ্ন দেখা যায়, তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, একটি দেশের স্বপ্নও। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে ক্ষতিটা সবার। তাই এখনই সময় সরকার, দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবার—সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর।

আরেকজন শিক্ষার্থীর গল্প আরও বেদনাদায়ক। দেড় বছর ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে মাস্টার্স করছিলেন, পড়াশোনাও ছিল শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ এক সকালে একটি ই–মেইল পান। তাতে জানানো হয়, তাঁর স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করা হয়েছে এবং যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে দেশ ছাড়তে হবে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ইসরায়েলি দখল ও গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি যে কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন, সেটিই তাঁর ভিসা বাতিলের কারণ। বর্তমানে ছেলেটি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। চেষ্টা করছেন অন্য কোথাও পিএইচডি করার সুযোগ খুঁজে নিতে। কিন্তু ভিসা বাতিলের রেকর্ড থাকায় তাঁর জন্য নতুন কোনো সুযোগ পাওয়া এখন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২.

গত ২৭ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বিশ্বব্যাপী দেশটির সব দূতাবাস ও কনস্যুলেটকে নির্দেশ দেন, যাঁদের ভিসার সাক্ষাৎকারের তারিখ ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়েছে, তাঁদের আবেদনপ্রক্রিয়া চলবে ঠিকই, তবে নতুন করে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা আবেদন গ্রহণ না করার নির্দেশ কার্যকর থাকবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের নতুন ভিসা আবেদনপ্রক্রিয়া স্থগিত রাখার বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে যে কূটনৈতিক তারবার্তা পাঠিয়েছেন মার্কো রুবিও, তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেদনকারীদের কর্মকাণ্ডসহ সামগ্রিক বিষয় আরও গভীরভাবে যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সব দূতাবাস ও কনস্যুলেটকে নতুন করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা আবেদন গ্রহণ স্থগিত রাখতে বলা হচ্ছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে।’

এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দেশে কারা আসছে, তা যাচাই-বাছাই (ভেটিং) করার প্রক্রিয়াকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখি এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। কেউ শিক্ষার্থী পরিচয়ে আসুক বা অন্য কোনো কারণে আসুক, তাঁদের পরিচয় ও কর্মকাণ্ড যাচাই করে দেখার সব উপায়ই আমরা ব্যবহার করব।’

ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে বিভিন্ন দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছর থেকেই কমতে শুরু করেছে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে দেশটির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ে এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থী যাওয়া আরও কমে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং অন্য অভিবাসীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ছয় হাজারের বেশি স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এসব ভিসার মধ্যে প্রায় চার হাজার বাতিল করা হয়েছে আইন ভঙ্গের কারণে, যার মধ্যে রয়েছে আক্রমণ, মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, চুরি ও সন্ত্রাসবাদে সমর্থন। যাঁদের ভিসা বাতিল হয়েছে, তাঁরা কতটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে।

৩.

বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবদান কি নেই? হুটহাট এভাবে তাঁদের ভিসা বাতিল করা যায়? ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্তে শুধু সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, যাঁরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিতে নির্ভরশীল; বরং স্থানীয় ও অঙ্গরাজ্যের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা কেবল টিউশন ফি পরিশোধ করেন না, তাঁরা বাড়িভাড়া দেন, খাওয়াদাওয়া ও দৈনন্দিন জীবনের জন্য রেস্তোরাঁ, দোকান ও ভ্রমণে অর্থ ব্যয় করেন।

আন্তর্জাতিক শিক্ষকদের অলাভজনক সংগঠন এনএএফএসএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ১১ লাখের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। এ সময়ে তাঁরা দেশটির অর্থনীতিতে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার যোগ করেছেন। এর মধ্যে আলাস্কার অর্থনীতিতে প্রায় ১ কোটি ডলার থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি অবদান রেখেছেন। পাশাপাশি তাঁরা ৩ লাখ ৭৮ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়তা করেছেন।

৪.

যুক্তরাষ্ট্রে যেসব ছয় হাজার স্টুডেন্ট ভিসা বাতিল করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। অথচ বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে পড়াশোনা ও গবেষণা চালিয়ে আসছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিদেশে গেছেন। তুলনামূলকভাবে, ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ হাজার। ২০২৪ সালের চূড়ান্ত সংখ্যা এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে গত বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছে, যা নতুন রেকর্ড এবং আগের বছরের তুলনায় ২৬% বৃদ্ধি, এমন তথ্য জানিয়েছে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে উপসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপেও বাংলাদেশিদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বেড়ে চলেছে, যা চিন্তার বিষয়। ভিয়েতনাম, লাওস, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এ কারণে শুধু পর্যটক নন, শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

৫.

বিদেশে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর জন্য পরিবার যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জীবনভর পরিশ্রমের ফল। একমুহূর্তের ভিসা জটিলতায় সেই বিনিয়োগ বৃথা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ক্ষতিটা কেবল টাকার নয়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি ঘটে মেধার। যখন একটি প্রতিশ্রুতিশীল মেধা মাঝপথেই আটকে যায়, তা শুধু শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, দেশের জন্যও এটি ক্ষতির বিষয়।

সত্যি কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা পেতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন। অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, হঠাৎ বাতিল হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কাগজপত্র যাচাই—সব মিলিয়ে তাঁরা অন্যায্য ভোগান্তির শিকার। এতে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ও মেধাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য?

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষারত এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বলছিলেন, এ ধরনের ভিসা আবেদনে যে খরচ হয়, তা ছাত্রদের জন্য অনেক। আবার ভিসা না পেলে সেই ফান্ড আরেকজনকে দিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক। একজন শিক্ষার্থীর জন্য সেটাও বড় ধাক্কা। কেননা, এই ফান্ড পেতে অনেক পরীক্ষা যেমন ইংরেজি ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা, অধ্যাপককে দফায় দফায় মেইল, ভাইভা পরীক্ষা দেওয়াসহ নানা প্রক্রিয়ার অংশ নিতে হয়। শেষ ধাপ হলো ভিসা। সেটা না পেলে মন ভেঙে যায়।

শিক্ষার্থীরা আসলে আমাদের অঘোষিত দূত। তাঁরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শুধু নিজেদের জীবন বদলান না, বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল করেন। তাঁদের প্রতি অবহেলা মানে দেশের মর্যাদা ছোট করে দেখা।

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি, সেখানে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের ভিসাপ্রক্রিয়াকে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরাপদ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের আগেভাগে প্রস্তুত করতে হবে, সঠিক কাগজপত্র ও নিয়মকানুন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।

তৃতীয়ত, যাঁরা ভিসা জটিলতার কারণে দেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের জন্য বিকল্প সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন অনলাইন কোর্স চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুবিধা তৈরি করা।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আজ দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। তাঁদের চোখে যে স্বপ্ন দেখা যায়, তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, একটি দেশের স্বপ্নও। সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে ক্ষতিটা সবার। তাই এখনই সময় সরকার, দূতাবাস, বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবার—সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর।

কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক

ই–মেইল: alim.zaman@prothomalo.com

(মতামত লেখকের নিজস্ব)