নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন
নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন

মতামত

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের দায়িত্ব সবার

প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ‘লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি’ পালন করে থাকে। এ উদ্যোগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমাজ তখনই সমৃদ্ধি লাভ করে, যখন নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সম্মান করা হয়, তারা যখন নিরাপদ থাকে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় অর্থবহভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

এই প্রচারাভিযান নিয়মতান্ত্রিক প্রতিকূলতাগুলো তুলে ধরার সঙ্গে আলোচনা, সচেতনতা ও সমাধানের পথও তৈরি করে। একই সঙ্গে এটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক প্রভাবসহ উদ্বেগজনক বাস্তবতাগুলোও প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজন নারীর একজন কোনো না কোনো ধরনের শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউএনএফপিএর যৌথভাবে পরিচালিত ২০২৪ সালের নারী নির্যাতন জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এই হার আরও বেশি। বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনাও উদ্বেগের কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। ইউএনএফপিএ-ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়, যা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার একটি রূপ।

বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের সমাধান দেশের বহুমাত্রিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিবার ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের মধ্যেই নিহিত

এসব পরিসংখ্যান মূলত গৃহস্থালি সহিংসতার ওপর গুরুত্ব প্রদান ছাড়াও নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইন ও জনসমক্ষে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও নির্যাতন মোকাবিলায় সমন্বিত প্রতিক্রিয়ার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরে। কেননা, এসব জায়গায় ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি সমাজে নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণে বাধাগ্রস্ত করে।

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি বৈশ্বিক উদ্বেগ। কোনো ধর্ম, সম্প্রদায় বা জাতি এর থেকে মুক্ত নয়। তথাপি সবচেয়ে কার্যকর সমাধান সেগুলো, যেগুলোর পদ্ধতিগত উৎপত্তি স্থানীয় ও সংস্কৃতিভিত্তিক। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি গঠন করতে পারে।

মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী ঐতিহ্য বা অন্য যেকোনো ধর্মই হোক না কেন, সহমর্মিতা, সম্মান, মর্যাদা ও অন্যদের সুরক্ষার মতো মূল্যবোধগুলো আমাদের সবার অনুসরণীয় নীতি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এ নৈতিক ভিত্তিগুলো লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় ও নিরাপদ সমাজ গড়ার সহায়ক হতে পারে। তবে শুধু মূল্যবোধই যথেষ্ট নয়, সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিশেষ করে পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন।

সহিংসতা প্রতিরোধ: একটি সম্মিলিত দায়িত্ব

লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় পুরুষ ও ছেলেশিশুদের অর্থবহ সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। ইতিবাচক পুরুষত্ববোধচর্চার মাধ্যমে তারা ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতিগুলোকে প্রশ্ন করার সহযোগী হতে পারে। এটি ঐতিহ্যকে প্রত্যাখ্যান করা নয়; বরং ন্যায়, দায়িত্ববোধ ও সুরক্ষার মতো মূল্যবোধ অনুসরণ করা। বাবা, ভাই, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতারা, যাঁরা এ মূল্যবোধ ধারণ করেন, তাঁরা নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নে এবং শক্তিশালী সম্প্রদায় গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিল্পী, আইনজীবী, উদ্যোক্তা, সেবাদাতা, শ্রমিক বা নেতা—নানা ভূমিকায় তাঁরা দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণকে সমর্থন করা শুধু পরিবার নয়, গোটা জাতিকে আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ করে। এর মাধ্যমে এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে, যেখানে নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সমতা হবে সবার সহজ অধিকার।

ডিজিটাল নিরাপত্তা ও উদীয়মান চ্যালেঞ্জ

এ বছরের বৈশ্বিক বিষয়বস্তু ‘নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধ করুন’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিরাপত্তা আজ অনলাইন ও অফলাইন—দুই পরিসরেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন হয়রানি, হুমকি, অপমান, ভুয়া পরিচয় ব্যবহার, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস—এসবের শিকার নারীর সংখ্যা বাড়ছে। এআইনির্মিত ডিপফেক, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, প্রতারণামূলক পরিচয় ব্যবহারসহ উদীয়মান ঝুঁকিগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এসব সহিংসতা অনেক সময় অব্যক্ত ও অগোচরে থেকে যায়, তবু এগুলো নারীদের জনজীবনে নিরাপদ ও সমানভাবে অংশগ্রহণের সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্য প্রভাবিত করে। এ প্রতিকূলতা মোকাবিলার জন্য নারীদের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্বসহকারে শোনা এবং নীতি ও পরিসর নির্ধারণে তাঁদের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।

এ প্রতিকূলতা মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও দৃঢ় অংশীদারত্ব। বাংলাদেশ সরকার, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় নেতাদের ও যুবসমাজের সঙ্গে মর্যাদা, সমতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পেরে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলো গর্বিত।

বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের সমাধান দেশের বহুমাত্রিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পরিবার ও সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের মধ্যেই নিহিত। ১৬ দিনব্যাপী এ কর্মসূচিতে আমরা আমাদের যৌথ প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে, যেখানে নারী ও মেয়েশিশুরা সহিংসতা থেকে মুক্তভাবে জীবন যাপন করবে এবং যেখানে পুরুষ ও ছেলেশিশুরা আরও ন্যায়সংগত, সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ গঠনে গর্বের সঙ্গে তাদের সহযোগী হবে।

  • অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন, বাংলাদেশ

  • ব্রিটিশ হাইকমিশন, বাংলাদেশ

  • কানাডিয়ান হাইকমিশন, বাংলাদেশ

  • ডেনমার্ক দূতাবাস, বাংলাদেশ

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দল, বাংলাদেশ

  • ফ্রান্স দূতাবাস, বাংলাদেশ

  • জার্মান দূতাবাস, বাংলাদেশ

  • ইতালি দূতাবাস, বাংলাদেশ

  • নেদারল্যান্ডস দূতাবাস, বাংলাদেশl

  • নরওয়ে দূতাবাস, বাংলাদেশl

  • সুইডেন দূতাবাস, বাংলাদেশ

  • সুইজারল্যান্ড দূতাবাস, বাংলাদেশ