মতামত

কেন বিদায় নিচ্ছেন ইশিবা এবং কে ধরবেন এখন জাপানের হাল

এক বছরের কম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে হচ্ছে শিগেরু ইশিবাকে। জাপানের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক পরিক্রমায় অল্প সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর এভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া অবশ্য নতুন কিছু নয়। একবিংশ শতাব্দীতে এ পর্যন্ত ১২ জনের মতো রাজনীতিবিদ যে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন, সেই হিসাবই বলে দেয় কতটা দ্রুত ক্ষমতার রদবদল জাপানে ঘটছে। তবে অন্যদিক থেকে বিষয়টির ওপর নজর দিলে ভিন্ন যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়বে, তা হলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের নীতিগত রদবদলের পথ তৈরি করে দেয় না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে মূলত একটি দলের ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করা এবং দলগত সেই আনুগত্য দলের অনুসৃত নীতি থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় না। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম আড়াই দশকে যেমন বারবার প্রধানমন্ত্রী বদল হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় প্রধানত ছিল উদার গণতন্ত্রী দল এলডিপি। অধুনালুপ্ত গণতান্ত্রিক দল ২০০৯ সালে সরকার গঠন করলে বড় ধরনের নীতিগত রদবদলের সম্ভাবনা দেখা দিলেও দলের ভেতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা হতে পারেনি। বিভিন্ন বিরোধী দলের সমন্বয়ে একত্র হওয়া সেই জোট প্রায় তিন বছর ক্ষমতাসীন থাকলেও দলের ভেতরে চলতে থাকা অন্তঃকলহের কারণে দ্রুতই ক্ষমতা থেকে দলকে সরে যেতে হয়েছে এবং এলডিপির আবারও রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসার সুযোগ এর মধ্য দিয়ে তৈরি হয়ে যায়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এলডিপি টানা ক্ষমতাসীন থেকে গেছে, নেতৃত্ব বদল হওয়ার ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ রাজনীতির যে ধারায় সমাপ্তি টানার পথ শিনজো আবে করে দিলেও তাঁর পদত্যাগের পর দলকে আবারও দেখা গেছে পুরোনো সেই ধারায় ফিরে যেতে।

শিগেরু ইশিবা হচ্ছেন আবে–পরবর্তী সময়ে জাপানের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, বলা যায়, আবের মৃত্যু যাঁর রাজনীতিতে ফিরে আসার পথ আবারও তৈরি করে দিয়েছিল। কেননা, এর আগে দলীয় সভাপতি পদের নির্বাচনে তিনবার তিনি আবের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হওয়ার পর সক্রিয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা একসময় দিয়েছিলেন। তবে আবের মৃত্যু তাঁর ফিরে আসার পথ তৈরি করে দিলেও দলের ভেতরে আবের অনুসারীদের আস্থা বা সমর্থন তিনি কখনো অর্জন করতে পারেননি এবং এই বাস্তবতা হচ্ছে অল্প সময়ে তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা প্রচারের প্রধান একটি কারণ, যদিও মূল কারণ অবশ্যই নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দলীয় সভাপতির নির্বাচনে দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভোটে সানায়ে তাকাইচির কাছে তিনি পরাজিত হলেও দলের সাধারণ সদস্যদের ভোট তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের পথ তৈরি করে দিয়েছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে তাকাইচি সদা প্রস্তুত ছিলেন এবং সেই সুযোগ তাঁর সামনে এখন মনে হয় উপস্থিত হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও বলতে হয়, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার সমাপ্তি এখানেই হচ্ছে না, বরং প্রতিযোগিতার সূচনা হিসেবেই এটাকে দেখা যেতে পারে। কেন? এ প্রশ্নে যাওয়ার আগে মনে হয় ইশিবার বিদায়ের পেছনে আর যে দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেদিকে আবারও নজর ফেরানো দরকার।

আবে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অনুগত সমর্থকদের জন্য বিশেষ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার কারণে এলডিপি দ্রুত সমর্থন হারাতে থাকা অবস্থায় গত বছর অক্টোবরের শুরুতে ইশিবা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, সংসদের নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিলে দল হয়তো হারানো অবস্থান কিছুটা হলেও ফিরে পাবে। তবে তাঁর সেই হিসাব ছিল মস্ত বড় এক ভুল এবং নিম্নকক্ষের সেই নির্বাচনের ফলাফলে দল প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথম নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে সংখ্যালঘু একটি সরকারের দায়িত্ব ইশিবাকে নিতে হয়েছিল। দলের ভেতরে তাঁর কঠোর সমালোচনার পথ এটা করে দেয়, চলতি গ্রীষ্মে অনুষ্ঠিত উচ্চকক্ষ নির্বাচনে আরও একটি বড় ধরনের স্খলনের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষেও দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ইশিবার সরে যাওয়ার পথ আরও প্রশস্ত হয়। তবে তা সত্ত্বেও ইশিবা এ কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে অস্বীকার করে আসছিলেন যে সাম্প্রতিক সব কটি জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থনের হার বৃদ্ধি পাওয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছিল এবং তিনি ধরে নিয়েছিলেন, এই প্রবণতা তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করা থেকে দলের নেতৃত্বকে বিরত রাখবে। তবে শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি এবং দলীয় নেতৃত্বের সর্বশেষ বৈঠকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে তাঁকে বলা হয়।

সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইশিবার পতনের প্রধান কারণ এটা হলেও আরও কিছু উপাদান এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি হলো শুল্ক হ্রাসের জন্য মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চলা আলোচনায় বিশাল কিছু ছাড় দিতে জাপানের রাজি হওয়া। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপান থেকে আসা আমদানি পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে বিষয়টি নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে কিছু একটা করার জন্য জাপানের নির্মাণ ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রচণ্ড চাপের মধ্যে সরকারকে পড়তে হয়। সে রকম অবস্থায় শুল্ক হ্রাসে ট্রাম্প প্রশাসনকে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সাফল্য দেখানোর চেষ্টায় ইশিবা এতটাই মগ্ন ছিলেন যে জাপানের স্বার্থের ক্ষতি হলেও তার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব তিনি আরোপ করেননি। ফলে জাপানের মোটরগাড়ির ওপর আরোপিত শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করায় ট্রাম্পের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর জাপানের জনগণ জানতে পারে, সেই ছাড় নিশ্চিত করে নিতে যে প্রতিশ্রুতি জাপানকে দিতে হয়েছে, তা হলো অনেকটা মার্কিন শর্তে সেই দেশে তিন বছর সময়ে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা। জাপানের অর্থনীতিতে কঠিন অবস্থা চলতে থাকার এ সময়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে এতটা বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি জাপানে ভালোভাবে দেখা হয়নি এবং ইশিবার সমালোচনা এর ফলে আরও কিছুটা সংঘবদ্ধ আকার নিতে পেরেছিল।

ইশিবার সরে দাঁড়ানো চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্ন এখন জাপানে সবাই করছেন, তা হলো, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কে গ্রহণ করবেন এবং সামনের সারির প্রার্থীদের মধ্যে কার সম্ভাবনাই–বা কতটুকু। সেই হিসাবে যাওয়ার আগে আরও যে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার তা হলো, এলডিপির ভেতরে চলা দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক চরিত্র। একক দল হিসেবে এলডিপিকে গণ্য করা হলেও দলের ভেতরে অনেক দিন থেকে চলতে থাকা ডান-বামের দ্বন্দ্ব আবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে চাপা পড়ে থাকলেও দলের আপাত দুরবস্থায় তা এখন অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জাপানের রাজনীতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের মতো ক্ষতিকর কিছু প্রবণতার কলুষিত প্রভাব দেশজুড়ে বিস্তৃত হতে থাকা অবস্থায় এলডিপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও এটা প্রভাবিত করছে এবং ডান-বামের সংঘাত এর ফলে আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

ইশিবা হচ্ছেন দলের প্রগতিশীল অংশের প্রতিনিধি, যার বিপরীতে অবস্থান করছেন তারো আসো ও সানায়ে তাকাইচির মতো রক্ষণশীল অংশের নেতারা। দ্বিতীয় দলের নেতারা চাইছেন ইশিবার পদত্যাগের সুযোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজেদের অনুসৃত নীতিমালাকে সরকারি পর্যায়ে নিয়ে যেতে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রায় সবাই এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই দলে সানায়ে তাকাইচি ছাড়াও আরও আছেন সরকারের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিমাসা হায়াশি, আবে সরকারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি এবং এলডিপির সাবেক মহাসচিব ও একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিৎসু মোতেগি। তবে যাঁর প্রার্থিতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে, ইশিবা সরকারের সফল সেই কৃষিমন্ত্রী শিনজিরো কোইজুমি অবশ্য এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে বলেননি, তিনি প্রার্থী হচ্ছেন কি না, যদিও এলডিপির প্রগতিশীল অংশ তার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করা দেখতে চাইছে। ২২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হওয়ার পর আগামী ৪ অক্টোবর দলীয় প্রধানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা সম্ভবত কোইজুমি ও তাকাইচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তাকাইচি নির্বাচিত হলে তিনি হবেন জাপানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

টোকিও, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মনজুরুল হক জাপানপ্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক