ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সাংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। এর সপ্তাহখানেক আগে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সামনে কথা হয়েছিল মো. তাফসিরুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল থেকে কার্যকরী সদস্য হিসেবে ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তাফসিরুল্লাহ একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
তাফসিরুল্লাহ জানিয়েছিলেন, তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাঁর সহপাঠী,বন্ধু ও পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছিলেন; কেউ কেউ আবার বাহবাও দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সব প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান তিনি।
তাফসিরুল্লাহ বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তুলনামূলকভাবে তাঁর পরিচিত এলাকা। এরপরও অন্যরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পেরেছেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে তিনি সেটা পারেননি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা বা লিফলেট বিলির মতো কাজগুলো তাঁকে অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে করতে হয়েছে। বন্ধুরা যতটা সময় দিয়েছেন, তিনি ততটুকুই প্রচার করতে পেরেছেন।
তাফসিরুল্লাহ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বা আদর্শিক কোনো পরাজয় নয়, প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মনোভাবেরও একটি পরিচয়।
তাফসিরুল্লাহর এ ঘটনা বাংলাদেশের একটি বৃহত্তর বাস্তবতাকে মনে করিয়ে দেয়। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীরা যে প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছেন—এটা তারই একটা উদাহরণ।
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা এখন পর্যন্ত নিরূপণ করা হয়নি। একেকটি জরিপে একেক রকম সংখ্যা পাওয়া গেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপের (ডিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৩৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৭৬।
অন্যদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে এখন মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। এর মধ্যে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হিসাব করলে ৪৬ লাখ প্রতিবন্ধী। (বিবিএসের জরিপ: দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ, প্রথম আলো অনলাইন, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২)
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। প্রথমে ছয়টি এবং পরে আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। কিন্তু সংস্কারের আলোচনায় কোথাও প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) যৌথ আয়োজনে ২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই সমীক্ষা ফলাফল অনুসারে দেশে প্রতিবন্ধিতার হার মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। (দেশে প্রতিবন্ধিতার হার ৮ শতাংশ: সমীক্ষা, প্রথম আলো অনলাইন, ১৯ নভেম্বর ২০২৩)
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী হতে পারে।
পরিসংখ্যানে তারতম্য থাকলেও বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা যে বিপুল, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি বা প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে।
ইউনেসকোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সুজান ভাইজ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই সবচেয়ে ভালো জানেন রাষ্ট্র ও সমাজে তাঁরা কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। তাই নীতি প্রণয়ন, রাজনীতি, নির্বাচনসহ সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জনজীবনের সব ক্ষেত্রে পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ পান।
গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে আমলে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। প্রথমে ছয়টি এবং পরে আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। কিন্তু সংস্কারের আলোচনায় কোথাও প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
এ বিষয়ে সুজান ভাইজ বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তাই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত ছিল। সংস্কারপ্রক্রিয়ায় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত না করাটা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। এর ফলে সমানভাবে অংশগ্রহণের বাধা থেকে যায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিবন্ধীরা এখন সক্রিয় রাজনীতির অংশ। যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য মার্শা দে করদোভা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও নারী ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়ন করেছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিভিন্ন সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্য। প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোর মতে, রাজনৈতিক দলের নীতি ও গঠনতন্ত্রে প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিত্বের বাধ্যতামূলক বিধান যুক্ত করা জরুরি।
মানবাধিকারকর্মী সাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে পাস হওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি কেবল মানবিক বিষয় নয়, এটা গণতন্ত্রের জন্যও প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিবন্ধী কোটার মতো উদ্যোগ নিতে পারে। তা না হলে প্রতিবন্ধীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে যাবেন।
প্রতিবন্ধী কোটার বিষয়ে সুজান ভাইজ বলনে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়নে কোটা থাকলে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনে সহায়তা করে এবং নীতি প্রণয়নে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হয়। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যও সংরক্ষিত আসন বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে শুধু কোটা নয়, এর পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ও তাঁদের বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক