
বিশ্বের বড় বাদাবন থেকে এলাম বৃহত্তম বন আমাজনে। আমাজনের ব্রাজিল অংশে দেশটির প্যারা রাজ্যের বেলেম শহরে গত সোমবার শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন বা কপ। ‘বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের’ সবচেয়ে বড় ‘জলবায়ু নাটকের’ ৩০তম আসর চলবে ১২ দিন।
সম্মেলনের প্রদর্শনী কক্ষে এক ‘বিশাল পৃথিবী’ ঝুলছে। ঘুরতে থাকা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বিমানযাত্রার কথা মনে আসে। টুপটাপ বসতি, দুরন্ত জমিন, ডবকানো মরুভূমি আর বিশাল সমুদ্রতলে রেখে মেঘের রেখায় উড়ছিল বিমান। জানালা দিয়ে দেখেছিলাম রুগ্ণ-দীর্ণ সব মেঘপুঞ্জ; আর নিচে ‘লুকিয়ে পড়া’ আমাদের পৃথিবী। লুকিয়ে পড়া পৃথিবীর প্রকাশ্য সব নির্দয় বাহাদুরির কারণেই আজ মেঘ, মাটি ও মাতৃদুনিয়া মুমূর্ষু। জীবাশ্ম জ্বালানি, কার্বন নিঃসরণ, অন্যায় ভোগবিলাস থেকে শুরু করে যুদ্ধ, সহিংসতা আর দখলের তর্ক।
ন্যায়বিচারের মঞ্চ হিসেবে ঘোষিত হলেও পৃথিবীর প্রকাশ্য সব বাহাদুরি এখনো এই জলবায়ুমঞ্চে জায়গা পায়নি। বিগত সম্মেলনগুলো সময়ক্ষেপণ, অঙ্গীকারভঙ্গ আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি হাজির করেছে কেবল। কিছুটা পথ একসঙ্গে উড়লেও বিমান থেকে নামার পর যাত্রীদের গন্তব্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
তবে জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দুনিয়ার সব নাগরিকের গন্তব্যই নিজস্বতাসহ এক কাতারে মিলতে হবে। না হলে হয়তো একদিন আমাদের এই গ্রহ তার ঘোরার শক্তি হারাবে। বেলেম জলবায়ু সম্মেলনের স্লোগানও করা হয়েছে ‘বৈশ্বিক মুটিরাও’। আমাজন বনের টুপি-গুয়ারানি আদিবাসীদের ভাষার শব্দ ‘মুটিরাও’ মানে হলো সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
দীর্ঘ বিমানযাত্রায় দ্য লোরাক্স ছবিটি দেখা হয়েছিল আবার। ২০১২ সালে ইউনিভার্সাল স্টুডিও থেকে নির্মিত অ্যানিমেশন ছবিটি সহজে দেখা যায় না নাকি নিষেধাজ্ঞার কারণে। হয়তো ছবিটি ভোগবাদ ও করপোরেট ক্ষমতার দাপটে রক্তাক্ত পৃথিবীর আখ্যান বলেছে সহজে তাই।
থিনিডভিল নামের এক শহরের কোথাও কোনো জীবিত গাছ ছিল না। সব প্লাস্টিক, সব মেশিনে চলে। ও’হেয়ার নামের একটি কোম্পানি শহরটি চালায়। বোতলে ভরে অক্সিজেন বিক্রি করে।
শহরের এ অবস্থা তৈরি হয় ওয়ান্স-লার নামের এক ব্যক্তির লোভের কারণে। সব গাছ কেটে সে থিনিডভিল শহর বানায়।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র নির্দয়ভাবে খুন হচ্ছে গাছপালা, প্রাণ ও প্রকৃতি।
প্রাণসংহারী উন্নয়ন উল্টাপাল্টা করে ফেলছে জলবায়ুপঞ্জিকা। যার বড় ভোগান্তি সামাল দিচ্ছে বিশ্বের গ্রামীণ নিম্নবর্গ ও প্রতিবেশব্যবস্থা। এই দুর্বিনীত অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর আওয়াজ উঠছে বিশ্বময়। দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল কেউ চায় না আমাদের পৃথিবীটা থিনিডভিল হোক। এমনকি বেলেম জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের জন্য আমাজন বনের এক বিশাল অংশ হত্যা করা হয়েছে। তর্ক আছে বিশ্বের ফুসফুসে ছিদ্র করে সম্মেলন আয়োজনের দরকার কী?
স্থানীয় সময় ১১ নভেম্বর ভোরে বেলেম শহরে নেমেই যেন একটি জঙ্গলের গন্ধ পাওয়া গেল। হতে পারে কোনো স্টেরিওটাইপ বা বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়-এর মতো কোনো বিস্ময়। সম্মেলন কর্তৃপক্ষ আমাজন বনের টুপি-গুয়ারানি আদিবাসীদের অরণ্যশক্তি ‘কুরোপিরা’কে বিপুল সম্মান জানিয়েছে। অরণ্যরক্ষক কুরোপিরা কেবল পৌরাণিক শক্তি নন, আমাজন বনে সাংস্কৃতিকভাবে প্রবহমান।
প্রাণসংহারী উন্নয়ন উল্টাপাল্টা করে ফেলছে জলবায়ুপঞ্জিকা। যার বড় ভোগান্তি সামাল দিচ্ছে বিশ্বের গ্রামীণ নিম্নবর্গ ও প্রতিবেশব্যবস্থা। এই দুর্বিনীত অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর আওয়াজ উঠছে বিশ্বময়।
কুরোপিরাকে দেখে বাংলাদেশের সুন্দরবনের বনবিবি, ঠুমনিয়া শালবনের বেলছিরি, কোলদের মারপা বোঙ্গা, সাঁওতালদের জাহেরথান কিংবা মধুপুর শালবনের হারানো মিদ্দিআসংয়ের কথা মনে পড়ে। সুন্দরবনের মৌয়ালি, বাওয়ালি, জেলে, বাগদি ও মুন্ডা বনজীবীরা বিশ্বাস করেন, মা বনবিবিই বাঁচিয়ে রেখেছেন বাদাবন। আর তাই বন ব্যবস্থাপনার বহু প্রথাগত রীতি ও লোকায়ত জ্ঞানকাণ্ড গড়ে উঠেছে সুন্দরবন অববাহিকায়। বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতি ও তৎপরতায় নিম্নবর্গের এমনতর জীবনভাষ্য কী প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বেলেম সম্মেলন?
বেলেম কপের সিইও আনা টনি অংশগ্রহণকারীদের প্রতি সম্মিলিত অ্যাকশন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বের সব ভূগোলে আদিবাসীসহ গ্রামীণ নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক সম্মিলিত প্রচেষ্টাগুলোই এখনো আমাদের আশার বিন্দু। সবাই মিলে কারও জমির ধান কেটে দেওয়া, খড়ের পালা বানানো, গোপাট ব্যবস্থাপনা, মাছ ধরা, মাটি কাটা, রাস্তা সংস্কার, খাল পরিষ্কার, সাঁকো বানানো, বন ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনা, মৃতের সৎকার, দুর্যোগ ও সংকটে সহায়তার সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টার নজির আছে বাংলাদেশে। প্রাণ ও পৃথিবীর জীবনরেখা জাগিয়ে রাখার নিম্নবর্গের এমনতর সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে রাষ্ট্র বা বিশ্বমঞ্চ কেউ কি মান্য করে? তাহলে পৃথিবীজুড়ে এত রক্ত, এত দাগ, এত বারুদ আর বিবাদ কেন? বিশ্বের সব দাবিয়ে রাখা মুটিরাও বা সম্মিলিত প্রচেষ্টাগুলোর বৈশ্বিক সংহতি জরুরি।
কুরোপিরাকে দেখে বাংলাদেশের সুন্দরবনের বনবিবি, ঠুমনিয়া শালবনের বেলছিরি, কোলদের মারপা বোঙ্গা, সাঁওতালদের জাহেরথান কিংবা মধুপুর শালবনের হারানো মিদ্দিআসংয়ের কথা মনে পড়ে।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের আশালতা মুন্ডা। সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে কি দিনমজুরি করেই চলে দিন। লবণপানি আর ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে চলে যুদ্ধ। বসতভিটা বদলাতে হয় বারবার। রাজশাহীর মোহনপুর ইউনিয়নের এক প্রাচীন কোল গ্রাম বাবুডাইংয়ের কৃষিমজুর রুমালী হাঁসদা। সম্প্রতি তাঁদের গ্রাম চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। কিছু বাঙালি কোল গ্রামের জায়গা তাঁদের বলে দাবি করেছেন।
গ্রামের প্রবীণেরা এখনো কালমুনি, ধইরা, সোনাশাইল, ঝিঙ্গাশাইল, কদমশাইল, সোনাকাঠি, ইন্দ্রশাইল ধানের গল্প বলেন। সেই সব ধানের জমিনে বাবুই পাখি বাসা বানাত। বাসা দেখে তাঁরা বৃষ্টির পূর্বাভাস পেতেন। পূর্বমুখী দরজা বানালে মেঘ নামত পশ্চিম দিক থেকে, উত্তরমুখী হলে দক্ষিণমুখী বৃষ্টি হতো। মাথাল পরীক্ষা, কচুপাতা পরীক্ষা, মাছ ধরার চাঁই পাতার মতো বহু লোকায়ত জলবায়ুজ্ঞান নিয়ে তাঁরা আলাপ করেন পরবের রাতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ (২০২৪) অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৪.২ শতাংশ নারী। এর ভেতর ৯৬.৬ শতাংশ নারী আশালতা বা রুমালীর মতো অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতে জড়িত (বিশ্বব্যাংক ২০২৪)। অনিশ্চিত জীবিকা, ভূমিহীনতা, জাতিগত প্রান্তিকতা সামাল দেওয়া সব নিম্নবর্গ নারীর জীবনশিখা আজ জলবায়ু-সংকটের মতো আরেক নির্মম বৈষম্যের মুখোমুখি।
সম্মেলনে আলাপ হয় বতসোয়ানার কৃষক ডিয়ান সিবান্দের সঙ্গে। খরা আর বৃষ্টিহীনতা তাঁর মতো গ্রামীণ নারীর জীবনজীবিকা এক অনিশ্চয়তার চক্রে ফেলে দিয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং মানবকেন্দ্রিক জলবায়ু অ্যাকশনের অঙ্গীকার নিয়ে একটি ‘বেলেম ঘোষণা’ তৈরি হয়েছে। ঘোষণায় সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খাদ্য উৎপাদকের সক্ষমতা বৃদ্ধির দাবি উঠেছে।
বেলেম জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম কাজ হবে পূর্ববর্তী বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলোর বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। বৈশ্বিক ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়ন, অভিযোজন, সক্ষমতা, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র্য, এনডিসি, প্রশমন বিষয়ে দেনদরবার; কিন্তু কে কার সঙ্গে দরবার করছে অনবরত? কার্বন দূষণের জন্য দায়ী বহুজাতিক কোম্পানি বা বিশ্বনেতারা কি আদৌ জলবায়ু-আঘাত সামলে বিশ্বব্যাপী সংগ্রামমুখর আশালতা, রুমালী বা ডিয়ানদের বয়ান শুনতে প্রস্তুত?
পাভেল পার্থ লেখক ও গবেষক
ই-মেইল: animistbangla@gmail.com