ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার আতঙ্কে আতঙ্কিত যখন বাংলাদেশের মানুষ, তখন অনাড়ম্বরভাবে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস। প্রতিবছর ২০ আগস্ট মশা ও মশাবাহিত রোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য পালন করা হয় মশা দিবস।
১৮৯৭ সালের এই দিনে ব্রিটিশ চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী স্যার রোনাল্ড রস আবিষ্কার করেন, ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাজমোডিয়াম মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার মশাবাহিত রোগ নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০২ সালে স্যার রোনাল্ড রস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বিশ্ব মশা দিবস মূলত মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি, প্রতিরোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পালিত হয়। মশা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার, জাপানিজ এনসেফালাইটিস এবং ফাইলেরিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুই বিশ্বব্যাপী শত শত মৃত্যুর জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মশাবাহিত রোগ বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মশামাহিত রোগের প্রকোপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ বা প্রতিবেশব্যবস্থার কাঠামোই বদলে দিচ্ছে না, বরং মশাবাহিত রোগের বিস্তার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ও ইয়েলো ফিভারের মতো রোগের বিস্তারে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরন এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব মশা দিবস আমাদের শুধু অতীতের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে স্মরণ করায় না, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। মশার বিরুদ্ধে লড়াই মানে মানবস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ—তিন ক্ষেত্রেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মশার প্রজনন ও জীবনচক্রের গতি বেড়ে যায়। উষ্ণ আবহাওয়ায় মশার ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় রূপান্তরের সময় অনেক কমে আসে, ফলে অল্প সময়ে মশার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে মশার শরীরে থাকা জীবাণু বা ভাইরাসও দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা সংক্রমণের হারকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আগে শীতল আবহাওয়া মশার বৃদ্ধি সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত করত, কিন্তু এখন উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এমন এলাকায়ও মশা জন্মানো শুরু করেছে, যেখানে আগে তারা টিকতে পারত না।
বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনও মশাবাহিত রোগের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান তৈরি করে। আবার অনিয়মিত বা দীর্ঘায়িত বর্ষা মশার প্রজননের মৌসুমকে বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে রোগের বিস্তার বছরজুড়েই ঘটতে থাকে।
অন্যদিকে খরা পরিস্থিতিতে মানুষ পানি সংরক্ষণ করে, যা সঠিকভাবে ঢেকে না রাখলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে মশার ডিম, লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশার বেঁচে থাকার হার বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার পরিবর্তন মশার সক্রিয় সময় ও বেঁচে থাকার সময়কালকে দীর্ঘায়িত করে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং ড্রেনেজ সমস্যার মতো বিষয়গুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও তীব্র করছে এবং মশার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে।
ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণের যৌথ প্রভাবে মশাবাহিত রোগ এখন এমন সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে আগে এগুলোর অস্তিত্ব ছিল না। সংক্রমণের মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে, নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিও বাড়ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা, পরিবেশবান্ধব মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ এখন জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যতে রোগের বিস্তার ও মৃত্যুহার উভয়ই উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য এমনিতেই মশার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বর্ষার ধরন পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মশাবাহিত রোগের প্রকোপ আরও তীব্র হয়েছে।
আগে যেখানে ডেঙ্গু প্রধানত বর্ষাকাল ও পরবর্তী সময়ে দেখা যেত, এখন বছরজুড়েই বিস্তার লাভ করছে। ম্যালেরিয়া ও ফাইলেরিয়ার মতো রোগও অনেক এলাকায় নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ হলো অনিয়মিত ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত। এর ফলে শহর ও গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা এডিস, কিউলেক্স ও অ্যানোফিলিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি করে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, প্লাস্টিক বর্জ্য ও জমে থাকা নোংরা পানি এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপরিষ্কার পরিবেশ মশাবাহিত রোগের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিও বাংলাদেশের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। উষ্ণ পরিবেশে মশার জীবনচক্র দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং তাদের শরীরে ভাইরাস বা পরজীবীর বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এর ফলে সংক্রমণের হার ও তীব্রতা উভয়ই বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাহাড়ি ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও মশাবাহিত রোগের বিস্তারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানুষের জীবনধারা ও অভ্যাসের পরিবর্তন। গরমের সময় বাড়িতে বা বাইরে জমে থাকা পানিতে মশা জন্মায়, আর শীতকালে যখন সংক্রমণ কম থাকার কথা, তখনো তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি থাকায় মশার প্রজনন অব্যাহত থাকে। গ্রামীণ এলাকায় পানির ট্যাংক, পুকুর ও নালা এবং শহুরে এলাকায় ভবনের ছাদ, ফুলের টব, নির্মাণাধীন ভবন ও ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল—সবই মশার জন্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে জলবায়ু অভিযোজন কৌশল গ্রহণ অপরিহার্য। শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়; বরং প্রয়োজন সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব দমনপদ্ধতি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শহর পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও মশাবাহিত রোগের সম্পর্ক যতটা জটিল, ততটাই জরুরি এর মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি ও স্থায়ী সমাধান।
আজকের দিনে বিশ্ব মশা দিবস কেবল একটি স্মরণ দিবস নয়, বরং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার একটি আহ্বান। জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের যাতায়াত—সবই মশাবাহিত রোগের বিস্তার বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে এডিস এজিপ্টি ও এডিস আলবোপিক্টাস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে শহুরে পরিবেশে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে।
শুধু মশা দিবসকে কেন্দ্র করে নয় সারা বছরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য খাত, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ, পরিবেশবান্ধব মশা নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শহর-গ্রামের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মতো কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি।
এ ছাড়া স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, গণস্বাস্থ্য প্রচারণা, কমিউনিটি ক্লিন-আপ ক্যাম্পেইন এবং গবেষণা ফলাফল প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো জরুরি যে মশা দমন শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
বিশ্ব মশা দিবস আমাদের শুধু অতীতের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে স্মরণ করায় না, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। মশার বিরুদ্ধে লড়াই মানে মানবস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ—তিন ক্ষেত্রেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
ই–মেইল: professorkabirul@gmail.com