অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র এবং জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়েছে। সিটি করপারেশনের কাউন্সিলর, পৌরসভার কমিশনার, উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্যদেরও একই পরিণতি। অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পলাতক। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের শূন্য পদে প্রশাসন ক্যাডারের যে কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের পক্ষে মানসম্মত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
মেয়র কিংবা চেয়ারম্যানরা পদে থাকাকালে জনগণ যেটুকু সেবা পেতেন, সেই সেবার মানও নিম্নগামী হয়েছে। কারণ, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অনেক ব্যস্ত। এই দায়িত্ব তাঁদের কাছে অতিরিক্ত। এসব দপ্তর কারা চালাচ্ছেন, সেটি জনগণের কাছে বিবেচ্য নয়, তাঁরা দেখছেন সেবার মান কমেছে। সাধারণের অনেকেই সেবা না পাওয়ার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
জনমনে প্রশাসন ক্যাডার সম্পর্কে সেবামূলক কাজে আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই তাঁদের কাজের চাপ কমিয়ে গতিশীল করতে হবে। নয়তো কারও জন্যই তা কল্যাণ বয়ে আনবে না
সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর এবং জনবান্ধব শহর রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বুঝলাম, রাজশাহী সিটি করপোরেশন আগের মতো চলছে না। শৃঙ্খলা আগের মতো নেই। অনেকে বলছেন, পরিচ্ছন্নতাও নানা কারণে কিছুটা কমেছে। উন্নয়নকাজও ব্যাহত হচ্ছে।
একজন রিকশাচালক জানালেন, আগে শহরের জন্য নির্দিষ্ট রিকশা চলাচল করত। এখন আর তা নেই। যিনি মেয়র ছিলেন, তিনি ছাড়া এই শহর ভালো চলবে না, এটা কিছুতেই নয়। বরং তিনি ছাড়া আরও ভালো চলতে পারে। না চলার কারণ হচ্ছে, যে বিভাগীয় কমিশনারকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁর কাছে এটি মূল দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কেন, যেকোনো ব্যস্ত কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব দিলেও তিনি সিটি করপোরেশন ভালোভাবে চালাতে পারবেন না।
বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশাসক করা হয়েছে অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনগুলোর। অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতেও প্রশাসন ক্যাডারের ব্যস্ত কর্মকর্তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আটটি জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (সার্বিক) এবং অবশিষ্ট জেলা পরিষদে ডিসিদের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।
পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। উপজেলা পরিষদের দায়িত্ব ইউএনওদের। যেসব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পলাতক আছেন, সেগুলোরও দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলার অনেক ব্যস্ত কর্মকর্তা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজের যে পরিমাণ চাপ, সেই চাপ সামলানো কঠিন। নিজ নিজ মূল কাজ করে অতিরিক্ত এত বড় বড় দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব।
বর্তমানে যাঁরা জেলা প্রশাসক কিংবা বিভাগীয় কমিশনার আছেন, তাঁরা প্রায় সবাই নতুন। তাঁদের পক্ষে নিজেদের কাজ করাই কঠিন। জেলা প্রশাসকেরা তো তিন শতাধিক কমিটিরও প্রধান। সেই কমিটির খবর নেবেন, নিজের দায়িত্ব পালন করবেন, নাকি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের শূন্য হওয়া পদের দায়িত্ব পালন করবেন। যত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আছে, সেগুলোর অর্থ ঠিকমতো ছাড় হচ্ছে না। উন্নয়ন খাতের টাকা যথাসময়ে ব্যয় না হলে ফেরত যাবে। তাহলে উন্নয়নকাজ হবে কীভাবে?
শিগগির স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে নতুন ভাবনা জরুরি। শূন্য হওয়া মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ছাড়া অন্যদের দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ আছে। হতে পারে তিনি উপযুক্ত যেকোনো যোগ্য ব্যক্তি কিংবা সরকারের যেকোনো দপ্তরের কর্মকর্তা। প্রতিটি বিভাগে, পৌরসভায় ও উপজেলায় নিশ্চয়ই এমন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা মেয়র কিংবা চেয়ারম্যানের শূন্য পদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আর যদি সরকারের যেকোনো দপ্তরের কর্মকর্তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তাঁর অন্য কোনো কাজ থাকা চলবে না।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যাঁরা দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁরা যে ওই দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন, তা নয়। বরং তাঁদের ওপর এসব দায়িত্ব দেওয়ার কারণে তাঁরা কোনো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না। এতে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এডিসি, ইউএনওদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নœ হচ্ছে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
আগে যেভাবে পুলিশ কার্যকর ছিল, এখন আর পুলিশ সেভাবে কাজ করছে না। পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে আগের মতো আস্থায় নিচ্ছে না। জনমনে প্রশাসন ক্যাডার সম্পর্কে সেবামূলক কাজে আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই তাঁদের কাজের চাপ কমিয়ে গতিশীল করতে হবে। নয়তো কারও জন্যই তা কল্যাণ বয়ে আনবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য দেশের একটি অংশ তৈরি হয়ে আছে। যাতে সেটি না হয় সে জন্য জন–আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জনসেবা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি শূন্যে নিয়ে আসা জরুরি। সব ধরনের কাজে গতিও আনতে হবে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া প্রশাসকেরা সেই চাহিদা পূরণে ব্যর্থ।
মানুষ চলমান সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চায়। কিন্তু নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না হলে সেই আস্থা থাকবে না, এটা ভাবতে হবে। কোটি কোটি মানুষ জুলাই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। এই আন্দোলন প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য নয়। আবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাও নিশ্চয়ই অতিরিক্ত কাজের চাপে ঠিকমতো সেবা দিতে না পারার ব্যর্থতার দায় নিতে চান না। এই বাস্তবতায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ কিংবা উপজেলা পরিষদ পরিচালনার জন্য বিকল্প ভাবনা অত্যাবশ্যক। নয়তো মাঠপর্যায়ের সব দপ্তর ধীরগতিতেই চলবে।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক