মতামত

২৫ মার্চের গণহত্যা: শুধু স্মরণ নয়, চাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো কেন পাওয়া যায়নি, তা নিয়ে লিখেছেন আরিফ রহমান

যে রাতে ঢাকা শ্মশানে পরিণত হয়েছিল, সেটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। আজ ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সেদিনের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে শুধু নয়, বরং বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া।

ওই রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে, তাকে অনেক গবেষক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষক নির্বিচার গণহত্যা বলেই অভিহিত করেন।

এই গণহত্যা যে কতটা সুপরিকল্পিত ছিল, তা বোঝা যায় এ পরিকল্পনার রূপরেখা, সামরিক প্রস্তুতি এবং পরবর্তী সময়ে উঠে আসা নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে।

শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পত্রিকা অফিস, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার ইপিআর ব্যারাক—সবখানেই বিনা বাধায়, নিরস্ত্র জনতার ওপর ট্যাংক-ট্রাক-সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে হামলা করা হয়।

ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং পরে দাবি করেন, শুধু ঢাকায় ওই এক রাতেই অন্তত সাত হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। আবার রবার্ট পেইন মনে করেন, এ সংখ্যা ৫০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কেউই অস্বীকার করেন না যে সেই রাতে ঢাকার পথে-ঘাটে-হোস্টেলের বারান্দায় অসংখ্য লাশ পড়ে ছিল। পরের দিনগুলোতে বিদেশি পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত কিছু দৃশ্য পৃথিবীর বিবেককে নাড়া দিয়েছিল, যদিও তখন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বেশির ভাগ বিদেশি সাংবাদিককে বহিষ্কার বা নিষিদ্ধ করে রাখায় তাৎক্ষণিকভাবে এই নিষ্ঠুরতা বিশ্বের দরবারে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

এত বড় সহিংস ঘটনা সত্ত্বেও একাত্তরের এই গণহত্যা কেন আজও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালো স্বীকৃতি পায়নি, সেই প্রশ্ন বহুবার উঠেছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এর পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।

প্রথমত, ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের গভীর সুসম্পর্ক ছিল। শীতল যুদ্ধের সময়কার জটিল ভূরাজনীতিতে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো পাকিস্তানকে ‘ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের বিরুদ্ধে’ গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলে বিবেচনা করত। ফলে পাকিস্তান সরকারের চালানো হত্যা ও নিপীড়নকে সরাসরি গণহত্যা আখ্যা দিতে কিংবা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে দায়ী করে নিষেধাজ্ঞা বা বিচারপ্রক্রিয়া চালাতে পশ্চিমা বিশ্ব খুব একটা উদ্যোগী হয়নি।

তা ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত সমর্থন ছিল প্রায় নিশ্চিত; আর চীনও রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান-বান্ধব ভূমিকা রাখত। তাই জাতিসংঘে বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক পরিসরে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করা যে সহজ ছিল না, সেটি বুঝে নেওয়া কঠিন নয়।

দ্বিতীয়ত, ২৫ মার্চের ওই রাতের পর একটানা ৯ মাস চলে মুক্তিযুদ্ধ, যার পরিণতিতে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন রাষ্ট্র তখনই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে—যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অস্থিরতা, খাদ্যসংকট, শরণার্থী পুনর্বাসন এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জটিল প্রক্রিয়া।

এই পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়া দেশকে গোছানো ও রাষ্ট্র পরিচালনার চাপে গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক কাঠামোতে তুলে ধরা বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যায়। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বারবার পশ্চিমা বিশ্বকে গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক আগ্রহের অভাবে বিষয়টি জোরালোভাবে আর এগোয়নি।

পাকিস্তান বরাবরই ১৯৭১ সালের ঘটনাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বা ‘গৃহযুদ্ধের ফল’ বলে এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানোর মতো ঐকমত্যের অভাব ছিল। সেই ফাঁকে শীতল যুদ্ধের রাজনীতি বদলে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া—সবার ভূরাজনীতিও পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু ১৯৭১-এর গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর আসেনি।

তৃতীয়ত, যারা ১৯৭১-এর গণহত্যার সংবাদ বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারত, সেই বিদেশি সাংবাদিকদের বেশির ভাগকেই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ওই বছরের মার্চ মাসের শেষ থেকেই দেশছাড়া করে দেয়। সাইমন ড্রিং, মিশেল লরেন্টসহ হাতে গোনা কয়েকজন ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন এবং সেখানকার ভয়াবহ ছবি ও রিপোর্ট বাইরে পাঠাতে পেরেছিলেন। তবে এসব রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে পশ্চিমা প্রশাসনগুলোর নীতিনির্ধারকদের মন গলাতে সফল হয়নি।

২৫ মার্চের পরও কঠোর সেন্সরশিপ জারি ছিল, ফলে দেশের ভেতরের ঘটনার অর্ধেকেরও কম বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত নানা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিপীড়ন যেভাবে চলেছে, তা যদি সময়মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রবলভাবে প্রচার পেত, তাহলে হয়তো সে সময়ের রাজনীতিতে অন্য রকম চাপ তৈরি হতো।

চতুর্থত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জেনোসাইড সনদ স্বাক্ষরিত হলেও এ ধরনের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনতে হলে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন দরকার হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরপরই ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার মুখোমুখি হয়।

এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক সহজে স্বাভাবিক না হওয়ার ফলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর্যায়ে সব পক্ষকে ঐকমত্যে আনা কিংবা বড় পরাশক্তিগুলোকে পাশে পাওয়া তখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বহু উত্থান-পতন ঘটেছে, সামরিক শাসন এসেছে, জনতার আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু সরাসরি ‘১৯৭১-এর গণহত্যা’কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেওয়ার পরিকল্পিত চেষ্টা রাষ্ট্রীয়ভাবে খুব বেশি এগোয়নি।

কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস হলো, ২৫ মার্চের সেই রাত আর পরবর্তী কয়েক দিনের গণহত্যা দেশের মানুষের মনে চরম ক্ষোভের জন্ম দেয়। নিরস্ত্র বাঙালিরা সাময়িকভাবে হয়তো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দ্রুতই গ্রামেগঞ্জে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের আগুন। পুলিশ, আনসার, ইপিআর—যারা পাকিস্তানি বাহিনীর অধীনে ছিল, তারাও বহু জায়গায় বিদ্রোহ করে, পালিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়।

সাধারণ মানুষ বুকের রক্তে আর অদম্য সাহসে যুদ্ধ করে যায় টানা ৯ মাস। সেই যুদ্ধেই জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। গোটা প্রক্রিয়ায় মার্চ মাসের হত্যাযজ্ঞ ছিল এক সুস্পষ্ট ইতিহাস-নির্ধারক মুহূর্ত, যখন নিপীড়িত জাতি বুঝতে পারে, আর পিছু হটলে চলবে না।

তারপরও এত বড় এক গণহত্যা কেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো না, সেটি একধরনের বেদনাদায়ক অধ্যায়। এ প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, বহু সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজেই কখনো জোরালোভাবে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেনি। বরং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনে বাংলাদেশের শাসকেরা বহুবার কূটনৈতিক ছাড় দিয়েছেন।

পাকিস্তান বরাবরই ১৯৭১ সালের ঘটনাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বা ‘গৃহযুদ্ধের ফল’ বলে এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিকল্পিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালানোর মতো ঐকমত্যের অভাব ছিল। সেই ফাঁকে শীতল যুদ্ধের রাজনীতি বদলে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া—সবার ভূরাজনীতিও পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু ১৯৭১-এর গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আর আসেনি।

তবে সময় গড়ানোর পরও বিষয়টি একেবারে হারিয়ে যায়নি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও জেনোসাইড বিশেষজ্ঞরা একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে এটি যে একটি পূর্ণাঙ্গ গণহত্যা, সে দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। গ্লোবাল জেনোসাইড ওয়াচ ২৫ মার্চের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেছে, ‘এটি বিশ্বমানবতার ইতিহাসে অন্যতম পূর্বপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের সূচনা।’

গবেষকদের মতে, গণহত্যা স্বীকৃতির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, সরকারি নথিপত্র—সবই বাংলাদেশের হাতে আছে। শুধু প্রয়োজন রাষ্ট্র পর্যায়ের সুসংগঠিত উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপন এবং বড় পরাশক্তিগুলোর প্রভাবশালী সমর্থন অর্জন।

২৫ মার্চের গণহত্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শাসকের নৃশংস পরিকল্পনা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সহযোগিতায় নিরপরাধ নাগরিকদের নির্মূল করার দিকে যায়, সেটি কোনো পরাশক্তির সমর্থনের ছায়ায় ঢেকে রাখা যায় না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে বাংলাদেশের শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সেই হত্যাযজ্ঞই মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত করে। যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী চেয়েছিল, মাত্র এক রাতের ভয়াবহ আক্রমণ দিয়ে বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রক্তাক্ত অধ্যায় স্বাধীনতার চূড়ান্ত স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে।

  • আরিফ রহমান লেখক ও গবেষক