প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে আগুন, হামলা, ভাঙচুরঘটনাগুলো লম্বা সময় ধরে ঘটেছে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে আগুন, হামলা, ভাঙচুরঘটনাগুলো লম্বা সময় ধরে ঘটেছে।

মতামত

উন্মত্ত গোষ্ঠী কখন সংবাদমাধ্যমকে সহজ লক্ষ্য বানায়

বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাসে দেখা যায়, হামলা ঘটে দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এক. রাষ্ট্র নিজেই যখন সংবাদমাধ্যমকে শত্রু ভাবে। দুই. রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়লে উন্মত্ত গোষ্ঠী সংবাদমাধ্যমকে সহজ লক্ষ্য বানায়। প্রথমটি ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তোলার সুসংগঠিত কর্মযজ্ঞের লক্ষণ।

ফ্যাসিবাদী লক্ষণ দেখা গেছে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে সামরিক শাসনের সময়। সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় আদেশে। বাংলাদেশে ’৭৪ সালেও তেমনটি ঘটেছিল।

অন্যদিকে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তোলার সুসংগঠিত কর্মযজ্ঞের লক্ষণ দেখা গেছে লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে। রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তুলতে সংবাদমাধ্যমে হামলা চালিয়েছে মিলিশিয়া ও উগ্র গোষ্ঠী, যাতে পত্রিকাগুলো গভীর গোপন আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অস্ত্র ও রাজনৈতিক পালাবদলের পেছনের খেলোয়াড়দের পরিকল্পনা ফাঁস করতে পারার বদলে নিজেদের বাঁচাতেই ব্যতিব্যস্ত থাকে। রাষ্ট্র যত দুর্বল হয়, উগ্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য তত বেশি পরিসর তৈরি হয়।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঝুঁকির পথে হাঁটছে।

প্রথম আলো ডেইলি স্টার পত্রিকা ভবনে আগুন, হামলা, ভাঙচুর, সাংবাদিক নূরুল কবীরের প্রতি অশোভন আচরণের ঘটনাগুলো লম্বা সময় ধরে ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল অসহায় দর্শকের ভূমিকায়। সীমাহীন গোয়েন্দা ব্যর্থতা দেখলেন সচেতন নাগরিকেরা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও আইন উপদেষ্টা ফেসবুক পোস্টে যেভাবে তাঁদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন, তাতেই প্রমাণ মেলে রাষ্ট্র ভাঙনের ঝুঁকিতে।

সংবাদমাধ্যম শত্রু নয়, তারা সংকেতদাতা। সতর্কবার্তাবাহী। অক্ষমের অপ্রাপ্তির কথা সবচেয়ে জোরালোভাবে বলার জায়গাটাই হলো সংবাদমাধ্যম। আমজনতা সত্যটি যেন ধরতে পারে, সংবাদমাধ্যমেরও সেই দিকটিতে সম্মিলিত নজর দেওয়া দরকার

ভাঙনঝুঁকির আশঙ্কার আরেকটি কারণ, ঘটনাটি ‘মব’ ঘটায়নি। সমাজবিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ ‘মব’ হুট করে উদয় হয়, আবার হুট করেই কর্পূরের মতো উবে যায়। মব নিজের মতো ভাবে না, আবেগে চলে, সহজে প্ররোচিত হয়। মব ঘটনায় কোনো নেতা বা সংগঠক থাকে না। মবকারীরাও কেউ কাউকে চেনে-জানে না; পরিকল্পনা থাকে না।

উদাহরণ—রাস্তায় ছিনতাইকারী ধরা পড়ল। উন্মত্ত জনতা কে কোথা থেকে এল না–এল বোঝার উপায় নেই। রাগে-ক্ষোভে আঘাতের পর আঘাত করল ছিনতাইকারীকে। কষে কয়েক ঘা দিয়ে কে কোথায় চলে গেল তার আর হদিস মেলে না।

‘মব র‍্যাশনালিটি’ তত্ত্বমতে, দু–একজন উসকানিদাতা থাকে বটে; কিন্তু তারা দায় নেয় না। পুলিশ বা প্রতিপক্ষ দেখলে সটকে পড়ে। ধরা পড়ে গেলেও দায় অস্বীকার করে বলে, ‘না বুঝে করেছি, অন্যরা সবাই করছে দেখে আমিও নাগরিক দায়িত্ব ভেবেছিলাম। সমাজের জন্য ভালো কাজই করছি ভেবে ভুলটি করে ফেলেছি। ভেবেছি, এতে ছিনতাইকারীরা আর অপরাধ করতে সাহস পাবে না’ ইত্যাদি।

 এবারের ঘটনাটি মোটেও মব-কর্ম নয়। দেখলাম, অপরাধীরা মিডিয়ার সামনে, বুমের মুখে মুখ লাগিয়ে, সজ্ঞানে-স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছে; তাদের অপরাধের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরছে; অন্যদের আহ্বান জানাচ্ছে তাণ্ডবে অংশ নিতে। সটকে পড়া দূরে থাকুক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এ সময় চুরি ও লুটপাট হচ্ছিল। তারা থামাতে যায়নি, উৎসাহিত করেছে। অর্থাৎ তাদের কাজ আদর্শিক প্রতিবাদ নয়। সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত অপরাধ করে যাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসনকালে তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় চাপে রাখত। অবদমনের পথ ছিল অসংখ্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন ছিল। অনেক সাংবাদিকের জবানিতে উঠে এসেছে—ভয় ও আতঙ্কের কারণে তাঁরা অনেক ফ্যাসিস্ট অবদমনের প্রতিবাদ করার জন্য মনেপ্রাণে ফুঁসে উঠলেও সাহসও পাননি। নীরব ছিলেন। আপস করেছিলেন।

কেউ কেউ চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। রাষ্ট্রীয় দমন ছিল সংগঠিত। পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি। মামলা-হামলা, ধরপাকড়, গুম, রাষ্ট্রীয় নির্যাতন তো ছিলই, আরও ছিল সাংবাদিক কিনে নেওয়ার খেলা। টাকাপয়সা, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, রাষ্ট্রীয় অর্থে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে, হাসিনার সফরসঙ্গী করে, সাংবাদিক সম্মেলনের নামে স্তুতির আসর বসিয়ে সংবাদমাধ্যমকে তটস্থ করে রেখেছিল।

ফ্যাসিজমের ভয় আর উগ্রবাদের ভয়ের পার্থক্যটি করতেই হবে। নইলে বিপদ বাড়বে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাধা নয়। তাই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ নিরাপদ। বাস্তবে সরকারের শক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে বসেছে সুসংগঠিত উগ্রবাদী গোষ্ঠীর শক্তি। তাদের পরিকল্পনা সূক্ষ্ম। বয়ান নির্মাণ এবং প্রচার-প্রসারের রয়েছে দারুণ সক্ষমতা। সক্রিয় থাকছে সুদীর্ঘ সময়—বছরের পর বছর। এমনি এমনিই খামখেয়ালি হঠাৎ উড়ে এসে হঠাৎ উবে যাওয়া ‘মব’ বৈশিষ্ট্যের একটিও এবারের অপরাধীদের বেলায় নেই।

সামাজিক মনোবিজ্ঞানের একটি পুরোনো তত্ত্ব ‘স্কেপগোটিং থিওরি’। আবেগপ্রবণ জনগণ হয়তো বুঝতেও অক্ষম—তাদের আবেগ ব্যবহার করছে সুদক্ষ কোনো খেলোয়াড়। তত্ত্বটি জানায়, যখন মানুষ ক্ষুব্ধ থাকে, অনিশ্চিত থাকে, তখন তারা জটিল সমস্যার সহজ শত্রু খোঁজে।

চলতি সময়ে সংবাদমাধ্যমই সেই সহজ শত্রু। কারণ, সংবাদকর্মীরা প্রশ্ন তোলেন, তথ্য দেন। আয়নায় মুখ দেখিয়ে দেন গণশত্রুদের; কিন্তু এ বর্গটি পেশাদার চরিত্রের কারণে উন্মুক্ত চলাচলপন্থী। পুলিশি পাহারা বা নিরাপত্তার চাদরে চলাফেরার প্রতি তাদের অশেষ ঘৃণা। উসকানিদাতারা এই মনস্তত্ত্ব ভালো করেই জানে এবং অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বাঘ-সিংহ শিকার করে।

অন্তত এবারের ঘটনাটি থেকে আমজনতার কয়েকটি অনুধাবন জরুরি। এক. সংবাদমাধ্যম দুর্বল হলে শক্তিশালী রাষ্ট্র কখনোই মিলবে না। শক্তিশালী হবে অদৃশ্য শক্তি, মিথ্যা, গুজব ও ষড়যন্ত্র। দুই. সংবাদমাধ্যম কোনো দল নয়, তারা প্রশ্ন করে। সংবাদপত্র ধ্বংস মানে আমজনতার কণ্ঠস্বর ধ্বংস। তিন. উসকানিদাতারা বিপদে ফেলবে ঠিকই, বিপন্নের পাশে থাকবে না, কখনোই থাকে না। উসকানিদাতারা সব সময়েই নিরাপদে থাকে। গ্রেপ্তার হলে আপনি একা হবেন, আপনার পরিবারই ভুগবে। চার. সহিংসতা কখনো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ‘শত্রু’ ভেবে পাথর যাকে মারছেন, সেই পাথর আপনার সন্তানের ওপর পড়ার আশঙ্কা প্রবল।

সংবাদমাধ্যম শত্রু নয়, তারা সংকেতদাতা। সতর্কবার্তাবাহী। অক্ষমের অপ্রাপ্তির কথা সবচেয়ে জোরালোভাবে বলার জায়গাটাই হলো সংবাদমাধ্যম। আমজনতা সত্যটি যেন ধরতে পারে, সংবাদমাধ্যমেরও সেই দিকটিতে সম্মিলিত নজর দেওয়া দরকার।

  • হেলাল মহিউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার মেভিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপনায় নিয়োজিত

    মতামত লেখকের নিজস্ব