১৯৪৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে যত সংঘাত হয়েছে, তার মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ সবচেয়ে বিধ্বংসী সংঘাত। পশ্চিমের অনেকেই যখন এ যুদ্ধকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ হিসেবে দেখছেন, তখন পুতিন বলেছেন, ২০০৮ সালে ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য বানানোর বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটি রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল; সে কারণে রাশিয়া এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। অন্য অনেকে মনে করেন, শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমারা রাশিয়াকে যথার্থ সমর্থন ও সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হওয়াও আজকের অবস্থার পেছনের একটি বড় কারণ। কিন্তু আগামী কয়েক বছর লড়াই চলবে—এমন আশঙ্কায় ছেয়ে যাওয়া এ যুদ্ধের উৎপত্তির আসল অনুঘটক কী, তা কি আমরা বুঝতে পারছি?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এক শতাব্দী আগে সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদেরা এখনো সেই যুদ্ধ কী কারণে ঘটেছিল, তা নিয়ে বই লেখেন। ১৯১৪ সালে একজন সার্বিয়ান সন্ত্রাসী একজন অস্ট্রিয়ান আর্চডিউককে হত্যা করাতেই কি এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটেছিল? নাকি শক্তিধর জার্মানি ব্রিটেনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এটি ঘটেছিল? নাকি ইউরোপজুড়ে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল? উত্তর হলো, ‘ওপরের সব কটি কারণ ঠিক, সঙ্গে আরও কারণ আছে।’ কিন্তু ১৯১৪ সালের আগস্টে আসল যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠেনি।
কারণগুলো বুঝতে আমাদের গভীর কারণ, মধ্যবর্তী কারণ এবং তাৎক্ষণিক কারণগুলো বুঝতে হবে।
পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় বারবার বিলাপ করেছেন এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে তিনি ইউক্রেনকে একটি তুচ্ছ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। অন্যদিকে ইউক্রেন অকৃতজ্ঞ ছিল। ২০১৪ সালের ময়দান অভ্যুত্থানে রাশিয়ানপন্থী সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের বাণিজ্য সম্পর্ক গভীরতর হয়েছিল। এটি পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে।
বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানোর কথা চিন্তা করুন। মনে করুন, বড় বড় কাঠের গুঁড়ি এক জায়গায় স্তূপ করার মানে হলো ‘গভীর কারণ’; তার ওপর লাকড়ি ও কাগজ বিছিয়ে দেওয়া হলো ‘মধ্যবর্তী কারণ’ এবং দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানো হলো ‘তাৎক্ষণিক কারণ’। কিন্তু দেশলাই জ্বালালেই অগ্নিকুণ্ড অনিবার্যভাবে জ্বলে উঠবে, তা নয়। কারণ বাতাসের ঝাপটা এসে দেশলাই কাঠিটি নিভিয়ে দিতে পারে, অথবা হঠাৎ বৃষ্টি এসে কাঠ ভিজিয়ে দিতে পারে।
ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার ক্লার্ক ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম দ্য স্লিপওয়াকারস। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘দুর্বল নীতি বেছে নেওয়া ছিল এই বিপর্যয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।’
এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই যে পুতিন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান সৈন্যদের আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটি জ্বালিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের তৎকালীন পরাশক্তিধর নেতাদের মতো তিনি সম্ভবত বিশ্বাস করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে ১৯৫৬ সালে বুদাপেস্ট ও ১৯৬৮ সালে প্রাগ দখল করেছিল, ঠিক সেভাবে রাশিয়ান সেনারা ঝড়ের গতিতে খুব সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে ইউক্রেন দখল করে ফেলবে; ছত্রীসেনারা দ্রুত বিমানবন্দর দখল করবে এবং অগ্রসরমাণ ট্যাংক কিয়েভ দখল করবে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অপসারণ করবে এবং ইউক্রেনে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে দেবে।
পুতিন রাশিয়ান জনগণকে বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেনকে ‘নাৎসিমুক্ত’ করার জন্য একটি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করছেন এবং ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমান্তে সম্প্রসারিত হতে বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর হিসাবে যে কত বড় ভুল ছিল, তা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা গেছে। আমরা পুতিনের নিজের লেখা থেকে এবং ফিলিপ শর্টের মতো বিভিন্ন জীবনীকারের কাছ থেকে জানতে পারছি, ‘মধ্যবর্তী কারণ’টি ছিল ইউক্রেনকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে অস্বীকার করা।
পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় বারবার বিলাপ করেছেন এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে তিনি ইউক্রেনকে একটি তুচ্ছ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। অন্যদিকে ইউক্রেন অকৃতজ্ঞ ছিল। ২০১৪ সালের ময়দান অভ্যুত্থানে রাশিয়ানপন্থী সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের বাণিজ্য সম্পর্ক গভীরতর হয়েছিল। এটি পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে।
পুতিন তাঁর ‘রাশিয়ান বিশ্ব’ পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন এবং ইউক্রেনে আক্রমণ করে বসলেন।
এসবের পেছনে ‘গভীর কারণ’ ছিল শীতল যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা। শীতল যুদ্ধের অবসানের প্রাথমিক পর্যায়ে রাশিয়া এবং পশ্চিম উভয়ই আশা করেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন রাশিয়ায় গণতন্ত্রের উত্থান ঘটাবে এবং সেখানে একটি বাজার অর্থনীতির জন্য অনুমতি পাওয়া যাবে। প্রারম্ভিক বছরগুলোতে, ক্লিনটন এবং ইয়েলৎসিন সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েওছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইয়েগর গাইদারের সরকারকে ঋণ ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিল, তখন রাশিয়ানরা বলল, তারা আরও অনেক কিছু আশা করেছিল। একটা বঞ্চনার বোধ রাশিয়ার মানুষকে ক্ষুব্ধ করল। সেই বোধকে কাজে লাগিয়ে পুতিন জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠলেন এবং পশ্চিমাবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তুললেন। তার একটা পরিণতি হিসেবেও এই যুদ্ধকে দেখা যেতে পারে।
তবে এর কোনোটিকেই ইউক্রেন যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলা কারণ হিসেবে দেখা যাবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে সম্ভাব্য হয়ে উঠেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ভুল হিসাব–নিকাশ করে তাঁর দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়েছেন। সেই জ্বলন্ত ম্যাচ–কাঠিটি খুব সহজে নেভানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক