মুক্তিযুদ্ধে কারও যদি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকে এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যদি সেখানে লজ্জাজনক ইতিহাস থাকে, তাহলে সে কেন মুক্তিযুদ্ধকে ইস্যু বানাবে না? এমনকি ডাকসুর মতো নির্বাচনে, যেটা মূলত ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচন, সেখানেও বাংলাদেশের মতো পটভূমিতে কেন অন্যান্য জাতীয় ইস্যুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ আসবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন জাহেদ উর রহমান
এই কলামের শিরোনাম দেখে কিংবা পড়তে পড়তে কারও কারও মনে কিছু প্রশ্ন জাগবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। সেই প্রশ্ন এবং আমার ব্যাখ্যা থাকছে এই লেখার শেষ দিকে।
মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির অনুষঙ্গ কিংবা ইস্যু করা নিয়ে আবার বিতর্ক সামনে এল ডাকসু নির্বাচন ঘিরে। ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির নিজ নামে না হলেও ভিন্ন নামের প্যানেলে নির্বাচন করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাসেও সম্ভবত ইসলামী ছাত্রশিবির দেশজুড়ে নামে-বেনামে এতটা প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ এর আগে কখনো পায়নি। তাই ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি এখন বেশ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে যখনই ইসলামী ছাত্রশিবির কিংবা তার মূল সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নিয়ে আলাপ হয়, তখনই অনিবার্যভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হয়।
ডাকসু নির্বাচনে এই আলাপ এসেছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই বলছেন, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বাংলাদেশে এত বেশি রাজনীতি হয়েছে যে এটা ‘বস্তাপচা’ (এই শব্দ ধার করেছি জনৈক জামায়াত নেতার বক্তব্য থেকে) বিষয়; তাই এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধকে রাজনীতির ইস্যু করার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা এমন একটা আলোচনা করতে পারেন, সেটা বোধগম্য। কিন্তু কিছুদিন আগে এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) আহ্বায়ক জনাব নাহিদ ইসলাম কাছাকাছি আলাপ তুলেছিলেন।
এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা ও একটি নতুন প্রজন্ম আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমরা একাত্তরকে অতিক্রম করেছি এবং চব্বিশে পৌঁছেছি। একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে—এই বাইনারির (দুই ধারার) ওপর ভিত্তি করে তৈরি রাজনীতিকে গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়। যারা এখনো এই পুরোনো রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা দেশকে একটি অচল রাজনৈতিক কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে চায়।’
জনাব নাহিদ ইসলাম যেভাবে বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে এই বাইনারির ওপর রাজনীতিকে গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটা আমাদের এই রাষ্ট্রের জন্য খুবই অশনিসংকেত। বিশেষ করে যখন আওয়ামী লীগের অবর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা জামায়াতে ইসলামী তাদের সেই সময়কার ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত তো নয়ই, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও অফিশিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) ক্ষমাও চায়নি।
শুধু সেটাই নয়, কিছুদিন আগে এক টিভি টক শোতে জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই নিবন্ধকারের সঙ্গে বসে আরেকজন আলোচকের মন্তব্যের জবাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে রাজনীতিতে আলাপ করাকে ‘বস্তাপচা’ বলে বিশেষায়িত করেছিলেন। (মুক্তবাক, চ্যানেল ২৪, ১৮.০৮.২৫)
জামায়াতের সব নেতা প্রকাশ্যে এভাবে বলে না ফেললেও তাঁদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান মোটাদাগে একই।
রাজনৈতিক দল তৈরিই হয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। জামায়াতে ইসলামী এমন একটা দেশে রাজনীতি করে এবং ক্ষমতায় যেতে চায়, যে দেশের জন্মের সময় তার বিপরীতে শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, অক্সিলারি ফোর্স (সহযোগী বাহিনী) তৈরির মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছিল।
তাই এই প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ কেন ইস্যু হিসেবে থাকবে না?
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আবার যখন ফিরে আসে, জামায়াত তখন একই নামে ফিরলেও তাদের ছাত্রসংগঠন আগের ছাত্রসংঘ পাল্টে ফেলে ছাত্রশিবির নামে সামনে আসে; অর্থাৎ কাগজে-কলমে ছাত্রশিবিরের জন্ম স্বাধীনতার পর।
কিন্তু এই ছাত্রসংগঠন তার মূল সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর মতোই একই চিন্তাভাবনা ও বোধ লালন করে। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে ছাত্রশিবিরের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা বহু সময় এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে দলীয় চিন্তার বাইরে অবস্থান নেওয়া ছাত্রশিবিরের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কয়েক দফায় বহিষ্কার করা হয়েছিল।
৫ আগস্টের পরও ছাত্রশিবির মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দিয়েছিল। এই বছরের জানুয়ারিতে ছাত্রশিবিরের এক প্রকাশনায় একজন লেখকের একটি মন্তব্য নিয়ে বেশ শোরগোল হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সেখানে লেখা হয়েছিল, ‘সে সময় অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’
এ ধরনের বক্তব্যকে ‘লেখকের ব্যক্তিগত মতামত’ বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হলেও মানুষের কাছে এই বার্তা ঠিকই পৌঁছে গেছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছাত্রশিবিরের মানসিকতা এখনো কী রকম।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের মতো ইস্যু এনে জাতিকে বিভক্ত করার চর্চা ভুল। তাহলে পাল্টা কি আমরা এভাবে প্রশ্ন করতে পারি না, গণতন্ত্র মানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি মানে মানুষের মধ্যে একধরনের বিভক্তি তৈরির চেষ্টা?
রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই চেষ্টা করবে তার মতাদর্শ এবং তার কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটা অংশের মানুষের সমর্থন নিজের পক্ষে এনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করা।
বলা বাহুল্য, মতাদর্শিক বিষয়ে এমন বয়ান পাল্টাবয়ানে সৃষ্ট বিভক্তি গণতান্ত্রিক সমাজে খুবই স্বাভাবিক। যেটা দেখা জরুরি, এই বিভক্তি এমন পর্যায়ে যেন না যায়, যেটা ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের মধ্যে শত্রুতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই সব মতভিন্নতা ও বিভক্তি নিয়েও শান্তিতে সহাবস্থান।
আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল রাখা জরুরি, কোনো রাজনৈতিক দল কোনো মতাদর্শিক বিষয় সামনে এনে সেটার মাধ্যমে তার ফ্যাসিবাদী মানসিকতা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় কি না বা নিজ মতাদর্শের বিপরীত মতাদর্শকে বল প্রয়োগে বাধা দেয় কি না? কোনো মতাদর্শিক ট্যাগ দেওয়ার মাধ্যমে কাউকে নির্যাতন, এমনকি হত্যাযোগ্য করে তোলা হয় কি না? বলা বাহুল্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চৌহদ্দির মধ্যে এগুলো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
শুরুতে পাঠকের মনে যে প্রশ্ন আসার কথা বলছিলাম, সেটা নিয়ে কথা বলা যাক। অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করছেন, মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলে আবার আওয়ামী (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভারতীয়) রাজনীতিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা হচ্ছে। আসলেই কি এমন অভিযোগ সত্য?
বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ১৫ বছরের শাসনে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আওয়ামীকরণ করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম (২০১৮ সাল পর্যন্ত; এরপর আওয়ামী লীগের শাসন ছিল মাফিয়া রেজিম) করে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিপক্ষের ওপর অন্যায়, নিপীড়ন চাপিয়ে দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
এমনকি নিজ বয়ানের বাইরে ইতিহাসচর্চা ঠেকানোর জন্য ভিন্ন বয়ানকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল তৎকালীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। কিন্তু সেই সময়েও এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতার সচেতন জনগণ।
নতুন বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বি–আওয়ামীকরণের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শতভাগ নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস বলে কিছু নেই, এই সত্য মেনে নিয়েও আমরা বলব, নানা দিক থেকে দেখে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিকতার কাছাকাছি পৌঁছাতে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বি–আওয়ামীকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও কি আর কোনো ইস্যু হিসেবে থাকবে না?
মুক্তিযুদ্ধে কারও যদি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকে এবং তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের যদি সেখানে লজ্জাজনক ইতিহাস থাকে, তাহলে সে কেন মুক্তিযুদ্ধকে ইস্যু বানাবে না? এমনকি ডাকসুর মতো নির্বাচনে, যেটা মূলত ছাত্রদের প্রতিনিধি নির্বাচন, সেখানেও বাংলাদেশের মতো পটভূমিতে কেন অন্যান্য জাতীয় ইস্যুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ আসবে না?
বর্তমান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমানে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই আওয়ামী কিংবা ভারতীয় বয়ানের ট্যাগ দিয়ে সেটা বন্ধ করার চেষ্টা আছে; চেষ্টা আছে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর বিরুদ্ধেও। সেই চেষ্টা কারা করছে ও কেন করছে, সেসব প্রশ্নের জবাব জানে জনগণ।
জাহেদ উর রহমান শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব