
আমাদের ইতিহাসে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দিনটি বিশেষ দিনে পরিণত হয়েছে। এই দিনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ দানব সরকারের অস্ত্রের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুই হাত প্রশস্ত করে দাঁড়িয়েছিল। বিশ্ববাসী দেখেছে বাঙালি তরুণের সাহস। বিশ্ব ইতিহাসেও আবু সাঈদ এক অনন্য চরিত্র হয়ে উঠেছে।
পুলিশের কয়েকজন সদস্য একসঙ্গে তাকে ঘিরে ধরে লাঠিতে মেরেছে। অকুতোভয় আবু সাঈদ এত মার খাওয়ার পরও অস্ত্রের সামনে দুই হাত প্রশস্ত করে দাঁড়াতে দ্বিধা করেনি। আবু সাঈদকে কাছে থেকে নির্মমভাবে ছররা গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এরপরও জীবনের এমন এক উচ্চতায় আবু সাঈদ পৌঁছে গেছে, যেখানে পৌঁছে গেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে।
শ্রেণিকক্ষে কোনো দিন উঁচু গলায় কথা বলেনি যে আবু সাঈদ, সেই কিনা কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হয়ে উঠেছিল নেতৃস্থানীয় সংগঠক-সমন্বয়ক। টিউশনিতে উপার্জন করে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেকে চালাতে হতো তাকে। সেই টাকা থেকে কিছু দিয়ে আন্দোলনও এগিয়ে নিয়েছে সে। তার জন্মস্থানে প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে তার বিনয়ের কথা শুনেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে–ই হয়ে উঠেছিল দুর্বিনীত।
সরকারি রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ অব্যাহত রেখেছিল শহীদ আবু সাঈদ। ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনীর মার খেয়েও দমে যায়নি, বরং নিজেকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল আন্দোলনে। সে সময় সরকার যা চাইত, তাই হতো। সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আবু সাঈদের মৃত্যু ঘটনাক্রমে নয়। বয়সে তরুণ হলেও তার বুদ্ধির স্তর ছিল পরিণত। বুদ্ধিদীপ্ত ছিল তার অবস্থান।
আন্দোলনকে চাঙা করতে ফেসবুকে সে নূরলদীন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, শামসুজ্জোহা, রফিক,শফিক, বরকতকে নিয়ে লিখেছে। সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে লিখেছে। আন্দোলনের যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেছে।
শহীদ আবু সাঈদ ১৫ জুলাই ফেসবুকে অনেকগুলো পোস্ট করে। সব কটি কোটা সংস্কারের জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক হলেও তার অর্থ কোটা আন্দোলনের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। শহীদ শামসুজ্জোহার মারা যাওয়ার আগের দিন কী বলেছিলেন, তা উল্লেখ করেও একটি পোস্ট দিয়েছিল। শহীদ শামসুজ্জোহার উক্তিটি—‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ আবু সাঈদের মন্তব্য ছিল—‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’ এটাই ছিল ফেসবুকে তার শেষ পোস্ট।
জীবিত আবু সাঈদের চেয়ে মৃত আবু সাঈদ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। শহীদ আবু সাঈদ জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছে মৃত্যুও কত সুন্দর হতে পারে, অর্থবহ হতে পারে। দেশজুড়ে আন্দোলনকারীরা যেন আবু সাঈদের মতো হয়ে উঠেছিল। তারাও মৃত্যুভয় পদদলিত করে এগিয়ে গেছে প্রতিদিন। সেই এগিয়ে চলার পরিণতি ৫ আগস্ট দানব সরকারের পতন।
১৫ জুলাই সরকারের এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কঠোর সমালোচনা করে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছে। এখানে লিখেছে, ‘আপনাদের মতের সাথে না মিললেই সে রাজাকার এই অপকৌশল এখন আর চলবে না।’ এই পোস্টের শেষে লিখেছে, ‘দেশের মাালিক দেশের জনগণ, কাজেই জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিন। সরকার যা চাইবে তাহাই হইবে এটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র হতে পারে না।’
১৪ জুলাই আবু সাঈদ লিখেছে, ‘আমিও তো সেটাই কই বাঁচলে বাঁচার মতো বাঁচব। কারও রক্তচক্ষু ভয়ে, ন্যায়কে ন্যায়, আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পিছুপা হবো না।’
১৩ জুলাই তারিখে আবু সাঈদ ফেসবুকে লিখেছে, ‘সবথেকে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো আপনি ন্যায়ের পক্ষে না অন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের পক্ষে থেকে ১০০ বছর বাঁচার থেকে ন্যায়ের পক্ষে থেকে মারা উত্তম, সম্মানের, শ্রেয়।’ ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শতবর্ষী হওয়ার বদলে ন্যায়ের পক্ষে থেকে মৃত্যকে বরণ করেছে বীরের বেশে। ফলে সে হয়ে উঠেছে মৃত্যুহীন প্রাণ।
আবু সাঈদ ফেসবুকে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার মতো পোস্ট দেওয়ার কারণ আছে। আবু সাঈদসহ অন্য যে সমন্বয়কেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কর্মসূচি পরিচালনা করেছে, তাদের কাউকে কাউকে ভয় দেখানো হয়েছিল। আন্দোলন বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছিল। সরকার, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন সবাই মিলে আন্দোলন বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে অতীতে অসংখ্য মানুষকে সরকার মেরেও ফেলেছে। ফলে আবু সাঈদ মৃত্যু হতে পারে জেনেও অনঢ় ছিল।
জীবিত আবু সাঈদের চেয়ে মৃত আবু সাঈদ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। শহীদ আবু সাঈদ জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছে মৃত্যুও কত সুন্দর হতে পারে, অর্থবহ হতে পারে। দেশজুড়ে আন্দোলনকারীরা যেন আবু সাঈদের মতো হয়ে উঠেছিল। তারাও মৃত্যুভয় পদদলিত করে এগিয়ে গেছে প্রতিদিন। সেই এগিয়ে চলার পরিণতি ৫ আগস্ট দানব সরকারের পতন।
যতক্ষণ দানব সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, ততক্ষণ আবু সাঈদকে নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচার করাও করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। মৃত আবু সাঈদের প্রতিও করা হয়েছে অবিচার। আবু সাঈদ মারা যাওয়ার পর আমি প্রায় ১২ ঘণ্টা মরদেহের সঙ্গে ছিলাম। গত বছর ১৬ জুলাই ৩টা ৫ মিনিটে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। আর এ মরদেহ আমরা হাসপাতাল থেকে নিতে পেরেছি রাত ১২টায়।
৯ ঘণ্টা মরদেহ হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। আমরা চেয়েছিলাম আবু সাঈদের মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেব। সেটি করতে দেওয়া হয়নি। ইংরেজি বিভাগের ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ নিতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ-র্যাব-প্রশাসনের বিশাল গাড়িবহর ছিল মরদেহবাহী গাড়ির সঙ্গে। আবু সাঈদের আত্মীয়স্বজন, কয়েকজন সহযোদ্ধা ছিল সঙ্গে। শিক্ষক বলতে সঙ্গে ছিলাম আমি একাই।
পথে প্রায় আধঘণ্টা একটি স্থানে মরদেহ আটকে রাখা হয়েছিল। আমরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালে গাড়ি আবারও চলতে থাকে। রাতেই দাফন করতে চেয়েছিল। আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী ও আমি বিরোধিতা করেছি। পরে সকালে আবু সাঈদের মরদেহ দাফন করা হয়।
এরই মধ্যে একটি বছর চলে গেছে। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিচারেও এসেছে অগ্রগতি। আমরা চাই, শহীদ আবু সাঈদসহ জুলাই অভ্যুত্থানের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রাণের বিসর্জন, সে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল জীবনদান সার্থক হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক