মতামত

ব্যাংক খাতের সংস্কারেও কেন খেলাপি ঋণ কমবে না

অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নীতিমালা হাজির করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব ও কর্মতৎপরতা প্রশংসনীয়। দীর্ঘ আমলা-নেতৃত্ব যুগের অবসান ঘটিয়ে প্রায় ৯ বছর পর আবার একজন অর্থনীতিবিদকে গভর্নর বানানো হয়েছে। তিনি বেশ কিছু নীতি সংস্কারে হাত দিয়েছেন। এগুলোর পেছনে মূলত আইএমএফের উদ্যম এবং বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সমর্থন রয়েছে।

এত সম্মিলিত উদ্যমের পরও প্রশ্ন থেকে যায়, মূল ব্যাধি তথা খেলাপি ঋণের রোগ আদৌ কি ব্যাংকগুলোর পিছু ছাড়বে? এ না ছাড়ার কারণ কি শুধুই রাজনৈতিক, নাকি ঋণ বিতরণ কৌশলের ভুল?

বড়লোক বাবার এক ছেলে বখাটে ও আরেক ছেলে কিছুটা দায়িত্ববান। বাবা চান ছেলেরা নিজের পায়ে দাঁড়াক। কিন্তু মায়ের অতি আহ্লাদে শেষতক বাবা তাদের মাসে মাসে মোটাদাগের তহবিল দিতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর দেখা গেল, বখাটে আরও বখাটে হয়েছে এবং ভালো ছেলেটিও নতুন করে ‘বাহুত্রা’ হয়ে গেছে। এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের চিত্র।

বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৫৭ লাখ কোটি টাকা। মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৩ লাখ কোটি টাকা আর ব্যক্তি খাতে এর পরিমাণ সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতে বিতরণ করা এ ঋণের শতকরা ২৪ ভাগ, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগই আজ খেলাপি।

কেউ বলছেন, মোট ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। এর পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এই মন্দ ঋণের সিংহভাগই গেছে ধনিক গোষ্ঠীর করপোরেট খাতে, তাদের দীর্ঘস্থায়ী পুঁজিপণ্য তৈরির কাজে, যা ছিল ঋণ বিতরণের গোড়াতেই ভুল। ব্যাংকঋণ যাওয়ার কথা অতি স্বল্পমেয়াদি কর্মরত পুঁজি বা ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল’-এর পেছনে। একটি কারখানায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় মেটাতে চলমান পুঁজির ব্যবহার হয়ে থাকে, যা চলতি সম্পদ ও চলতি দায়ের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।

এক কোটি টাকার মোট অ্যাসেটধারী কোনো কোম্পানির চলতি অ্যাসেট হতে পারে ১৫ লাখ টাকা আর চলতি দায় ১০ লাখ টাকা। এখানে কর্মরত পুঁজির পরিমাণ [১৫-১০=] ৫ লাখ টাকা। কর্মরত পুঁজির অনুপাত হচ্ছে [(১৫/১০)=] দেড় বা ১ দশমিক ৫, যা মোটামুটি ভালো মাত্রা বলে ধরে নেওয়া যায়।

এই কোম্পানি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হবে, এটি স্বাভাবিক। ৫০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কাজে এ কোম্পানিকে যেতে হবে পুঁজিবাজারে। হয়তো ২০ লাখ টাকার বন্ড আর ৩০ লাখ টাকার শেয়ার ছেড়ে তাকে মেশিনের টাকা তুলতে হবে। এটিই করপোরেট সংস্কৃতি, যা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অনেকটা নষ্ট করে দিয়েছে বড়লোককে পুরো বিনিয়োগের টাকা দিয়ে। বখাটে ছেলে হয়েছে আরও উড়নচণ্ডী, ভালো ছেলেটিও নষ্ট হয়েছে। কারণ, তাকে আত্মনির্ভর হওয়ার সঠিক চর্চা শেখানো হয়নি। ঋণ বিতরণে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর উত্তম চর্চা অনুসরণ করা হয়নি।

কেউ বলবেন, ওরা প্রভাব খাটিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। এটিও ঠিক কথা। সে জন্যই পুঁজির অর্থায়নে কঠিন নীতিমালার প্রয়োজন। এখানে সংস্কার যতটা প্রাসঙ্গিক তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক সংস্কারের কৌশল বা ‘অ্যাপ্রোচ’।

খাদে পড়ে যাওয়া ব্যাংক খাতকে গর্ত থেকে তুলে আনতে সরকার গঠন করবে ‘সংকট ব্যবস্থাপনা পরিষদ’। সংস্কারের নতুন ফর্দে রয়েছে ১. দেউলিয়াত্ব আইন, ২. অর্থঋণ আদালত আইন, ৩. আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ৪. ব্যাংক কোম্পানি আইন, ৫. ব্যাংক সিদ্ধান্ত অধ্যাদেশ ও ৬. রুগ্ণ অ্যাসেট ব্যবস্থাপনা আইন।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন গরিবকে বিনা মূল্যে মশারি কিনে দিতে। এতে শেষতক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় কমে আসে। গ্রামে শুনেছি, ‘কানে কচু নাকে তেল/ তার বাড়ি না বদ্যি গেল’। সর্বত্রই কর্ম পূর্বসতর্কতার জয়জয়কার থাকলেও ব্যাংকঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এটি প্রকটভাবে অনুপস্থিত। তাই শত সংস্কারেও খেলাপি কমেনি, কমবেও না।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ২০২৫ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা এবং গভর্নরকে স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক পদে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দান করবে। তদুপরি খেলাপি ঋণ কেনাবেচার জন্য একটি বাজারমঞ্চ তৈরির কথাও বলা হচ্ছে সংস্কারের বিশদ নীতিমালার গ্রন্থনায়। একসঙ্গে ব্যাংক সংস্কারের এত মহা আয়োজন স্বাধীনতার পর আগে আর কখনো ঘটেনি। কিন্তু এখানে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ বাদে বাকি সবই হচ্ছে রোগমুক্তির দাওয়াই—লুণ্ঠিত খাতের চিকিৎসা। এখানে অসুখের পূর্ব প্রতিরোধের চেয়ে রোগ-পরবর্তী ওষুধের কথাই বেশি। ‘কিউর’ বেশি, ‘প্রিভেনশন’ কম।

ফুটবল খেলায় ‘ডিফেন্স প্লেয়ার’ ভালো হলে ‘গোলকিপার’–এর ওপর চাপ কমে। বিদেশে একবার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলে আর পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশে ভালো চালকদের তিন বছর পরপর ‘ডিফেন্সিভ ড্রাইভিং’–এর পরীক্ষায় উৎসাহিত করা হয়। গাড়ি বিমায় ছাড় পাওয়া যায়।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন গরিবকে বিনা মূল্যে মশারি কিনে দিতে। এতে শেষতক স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় কমে আসে। গ্রামে শুনেছি, ‘কানে কচু নাকে তেল/ তার বাড়ি না বদ্যি গেল’। সর্বত্রই কর্ম পূর্বসতর্কতার জয়জয়কার থাকলেও ব্যাংকঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এটি প্রকটভাবে অনুপস্থিত। তাই শত সংস্কারেও খেলাপি কমেনি, কমবেও না।

ধরা যাক, এক লাখ করিমন, ছমিরন, খেদমত ও দুলাল তাদের ছোটখাটো সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রাখে, যার মোট পরিমাণ এক কোটি টাকা। ব্যাংক এ স্বল্পমেয়াদি আমানতগুলো একদাগে শিল্পপতি হিম্মত আলীকে ঋণ হিসেবে দিয়ে দেয়, যা দিয়ে হিম্মত এক কোটি টাকার ছাপাখানা কিনে ফেলে। শূন্য-ক্ষতি-শূন্য-লাভ বা ‘ব্রেকইভেন’ পয়েন্টে পৌঁছাতেই এই মেশিনের সময় লাগবে পাঁচ বছর। অথচ ছমিরন ও দুলাল এক বছরের মাথায় তাদের আমানত ফেরত চাইছে।

এখানে যে তহবিল পক্বতার অসামঞ্জস্যতা বা ‘ম্যাচুরিটি মিসম্যাচ’ হতে পারে, তা ব্যাংক আগে থেকে জানলেও সেটি আমলে নেয়নি। স্বল্পমেয়াদি তহবিল গ্রহণ করে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ প্রদান করলে ব্যাংক–ব্যবস্থা এমনিতেই অচল হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে করণীয় কী?

বড় বড় ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কর্মরত পুঁজির বাইরে যাওয়া যাবে না—এমন নীতিমালা সংস্কারে যুক্ত না করলে খেলাপির সমস্যা কোনো দিনই মিটবে না। চাই ‘নিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ আইন’। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে পুঁজিবাজারে যাবে বড় বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনে। ফলে ইকুইটি বাজার সম্প্রসারিত হয়ে শেয়ারবাজার চাঙা হবে। ভারতের বড় কোম্পানিগুলো কারখানা, মেশিন বা স্থায়ী যন্ত্রপাতির জন্য শেয়ারবাজারের দ্বারস্থ হয়। ভারতে জিডিপির অংশ হিসেবে বাজার মূলধনের পরিমাণ ২০২৪ সালে ছিল ১৩৩ শতাংশ, যা বাংলাদেশের জন্য ছিল ২০ ভাগের কম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশের জন্য জিডিপির অংশ হিসেবে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের দখল শতকরা ৫০ ভাগ হলে ভালো হয়। বিপদের কথা হচ্ছে, ভারত যেখানে বাজারপুঁজির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রেখেছে, বাংলাদেশের জন্য তা নিম্নমুখী। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ২০২৪–এর ১৪ আগস্টে ছিল ৫ হাজার ৯৫৩। ঠিক এক বছর পর তা হয়েছে ৫ হাজার ৩৫০। চট্টগ্রামের সূচকটি ১৭ হাজার ১৪২ থেকে ১৪ হাজার ৮৭৩-এ ঠেকেছে। ব্যাংকঋণ বিতরণের ভুল নীতিই বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে অনেকটা অকার্যকর করে ফেলেছে। ব্যাংক নিজেও ডুবেছে, পুঁজিবাজারকেও চির শীর্ণ ও পঙ্গু করে রেখেছে।

শিল্পপতি যদি শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি উত্তোলন করতে যান, তাহলে তাঁকে তাঁর ব্যবসার যাবতীয় বিবৃতিপত্র ও ক্যাশের অবস্থা তুলে ধরে ভবিষ্যৎপত্র বা ‘প্রসপেক্টাস’ দিতে হয়। ধরতে হয় বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোকে। এরপর ‘আইপিও’ বেচে টাকা তুলে আবার বছর বছর শেয়ারধারীদের সামনে জবাবদিহি করতে হয়। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে পদে পদে এত পরীক্ষায় পাস করতে হয় না। অনেক সময় এক টেলিফোনেই অনেকটা ‘দরবেশ’ স্টাইলে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করা হয়। ফেরত দেওয়ার সময় হলে গভর্নরকে বলে নতুন আইন বানিয়ে ফেলা যায়। তাই ঋণ বিতরণ কৌশলের গোড়ায় গলদ না সারালে শত সংস্কারেও খেলাপি ব্যাধির নিরাময় সম্ভব নয়। এর পরিবর্তন আনাই হোক আজকের সংস্কারের মূল লক্ষ্য।

  • ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক

    *মতামত লেখকের নিজস্ব